পল্লীবাংলার পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কালজয়ী ‘মামার বাড়ি’ কবিতার পংক্তি ‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ,। মধুমাস জৈষ্ঠ্যের মতো অগ্রহায়ন মাসেও রসনা তৃপ্তির জন্য মধু পাওয়া যায়। তা হচ্ছে মধুবৃক্ষের রস, অর্থাৎ খেজুরের রস।
এ অঞ্চলে একটি গ্রাম্য প্রবাদবাক্য আছে ‘মাটির হাড়ি কাঠের গাই, গলা কেটে দুধ খাই’। গাছসহ খেজুরের রস বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কালান্তরে চলে যাবে এসব প্রবাদ বাক্যও। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। গ্রামীণ জনপদে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে পুকুর পাড়ে রাস্তার ধারে পরিবেশ বান্ধব খেজুরগাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্তমানে খেজুর গাছে লাভ কিংবা পর্যাপ্ত রস না পাওয়ায় সব গাছ কেটে ধানি জমি বানিয়ে ফেলছে কিংবা অন্য গাছ রোপণ করছে।
তাছাড়া রয়েছে রাক্ষুসে ইট-ভাটার রাহু গ্রাসের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে তা নির্বিচারে নিধন করায় দিন দিন খেজুর গাছ বিলুপ্তির পথে। রামগঞ্জ উপজেলাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ধীরে-ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ এবং হারিয়ে যাচ্ছে ‘গাছি’ নামক শিল্পীরা। সেইসাথে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে শীতকালীন ঐতিহ্য খেজুরের রস। কয়েক বছর আগেও শীতের সকালে রসের হাঁড়ি নিয়ে গাছিরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন।
এখন আর সেই দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। বর্তমানে নানা অজুহাতে কেটে ফেলার কারণে বিলুপ্তির পথে খেজুর গাছ। সে কারণে শীতে আর মেলে না খেজুর রস। বিকালে চোখে পড়ে না খেজুর গাছ কাটার দৃশ্য। রামগঞ্জ উপজেলাসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে খেজুর গাছ থাকলেও গাছির অভাবে মিলেছে না রসের দেখা। সভ্যতার উন্নয়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গাছিরা। খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে সংসারের যাবতীয় খরচ তারা সামলাতে পারছেনা। তাই বর্তমানে এ ব্যবসার প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। গত এক দশক আগেও গ্রামেগঞ্জে বাড়ি বাড়ি খেজুরের রস বিক্রি একটা সাধারণ ব্যাপার ছিলো।
আর এখন হাট বাজারেও মেলে না রসের দেখা। ঐতিহ্যগতভাবে শীতের ভোরে একগ্লাস খেজুরের রস পান করতে ইচ্ছা জাগে রসনা বিলাসীদের। গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যের বাহক এই মধুবৃক্ষ তুলনামূলকভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। গ্রামে মাঠের ধারে মেঠোপথের কিনারে অথবা ঘরের কোণে খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে থাকতে এখন আর চোখে পড়েনা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই খেজুরগাছ আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। কারণ যে হারে খেজুরগাছ নিধন করা হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ করা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে দু’একটি খেজুরগাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
শীত মৌসুমের সকালে খেজুরের তাজা রস ও রসে ডুবানো পিঠার স্বাদ আর মৌ-মৌ গন্ধ যে কতটা মধুর তা বলে শেষ করা যাবেনা। শীতের সকালে ভাপা পিঠার সাথে খেজুরের রস খাওয়া গ্রাম বাংলার পুরনো রেওয়াজ। প্রাচীনকাল থেকেই শীত ও খেজুরের রস যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত রস সংগ্রহ শুরু হয়।
তবে পৌষ ও মাঘ মাসে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায়, এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে রস ও কমতে থাকে। কুয়াশা মোড়া সকালে গাছিরা গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাঁড়ি হাঁড়ি রসের ধুম পড়ে যায় গ্রামাঞ্চলের হাটে বাজারে। শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ যেমন অবর্ণনীয়, তেমনি জ্বাল করা রসের তৈরি বিভিন্ন পিঠা পুলির স্বাদও অমৃত। তাছাড়া, খেজুর রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, সময়ের পরিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস। খেজুর রস দিয়ে স্থানীয় গাছিরা চিতই- রসে ভিজানো পিঠা (গ্রামের প্রিয় পিঠা), পাটালি, নারকেল পাটালি, নালি গুড় দানা গুড় তৈরি করে। এই নালি গুড়ের খুবই চাহিদাও রয়েছে। খেজুরের রস ভাঁড় (ঠিলে) ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা বিক্রি করে পাটালি গুড় বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে ১৫০ টাকা থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত। নালি গুড় বিক্রি হয় ১৭০ টাকা থেকে ১৯০ টাকায়।
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নালি ও পাটালি গুড় তৈরির পর্ব চলে প্রায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। রামগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, খেজুর গাছ এবং এর রস ঐতিহ্যগতভাবে বাংলার সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। পুষ্টিগুণ এবং মিষ্টতায় এর জুড়ি মেলা ভার। খেজুরের রস থেকে তৈরী গুড় বাংলার পিঠা উৎসবের মূল অনুসঙ্গ। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পতিত জমিতে এবং রাস্তার দু’পাশে খেজুর গাছ লাগানো যেতে পারে। এতে পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নান্দনিকতার ছন্দ ছড়াবে।