পবিত্র রমজানের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা- এ ধরনের নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে অসাধু চক্র। এই চক্রের হাতেই জিম্মি সাধারণ ক্রেতারা।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, রোজায় আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে ৩০ ভাগ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন অসাধু চক্র কৌশল পাল্টেছে। আগে রোজা শুরু হলে দাম বাড়ত। এবার রোজার দেড়-দুই মাস আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগকারীদের জন্যও ভালো নয়, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের জন্যও খারাপ এবং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাও কমায়। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বনশ্রীর বাসিন্দা কায়সার আহমেদ বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ে; কিন্তু সেই হারে আমাদের বেতন বাড়ে না। এ বছর বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে ২৫ হাজার টাকা হয়েছে। প্রতি মাসে ইউটিলিটি বিলসহ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিই। যাতায়াত, মোবাইল বিলসহ আনুষঙ্গিক বাবদ খরচ হয়ে যায় আরো অন্তত সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৮ হাজার টাকায় চলে বাবা-মা, স্ত্রীসহ তাদের ৪ জনের সংসারের বাকি সব খরচ।
কায়সার বলেন, সরকারের কথা বলেন আর ব্যবসায়ীদের কথা বলেন, সবাই সমন্বয় করছে, দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা আগে যা আয় করতাম, এখনো তো প্রায় একই আয় করছি। তাহলে আমরা সমন্বয় করব কীভাবে? যে বেতন পাই তা দিয়ে আগেই যেখানে সংসার চালাতে কষ্ট হতো, এখন কীভাবে টিকে থাকব? একই কথা জানান রামপুরার বাসিন্দা মো. আবু তালিবও।
তিনি বলেন, বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে দৈনন্দিন খরচের তালিকা কাটছাঁট করতে করতে এমন জায়গায় এসে গেছে, এর চেয়ে আর কমানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে তো বাঁচতে হবে। তারপরও হিসাব মেলাতে পারি না। প্রতি মাসেই ধার-দেনা করতে হয়। এসব টাকা কবে-কীভাবে ফেরত দেব জানি না।
ঢাকার নবাবপুরের ইলেকট্রিক পণ্যের ব্যবসায়ী রাফিউল আলম বলেন, নিজেদের জন্য তো দূরে থাক, বাসায় শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় এলেও আর গরু বা খাসির মাংস রান্নার কথা চিন্তা করতে পারি না। মুরগির দামও যেভাবে বাড়ছে, এটাও হয়তো আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আমাদের দোকানে বিক্রির অবস্থা ভালো না। মানুষ নিতান্ত না ঠেকে গেলে কিছু কিনছেন না। এ মাসের দোকান ভাড়া, বাসা ভাড়ার ব্যবস্থাও এখনো করতে পারিনি। মাস কীভাবে শেষ হবে সেই চিন্তায় আছি, যোগ করেন তিনি।
ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রবিন ইসলাম জানান, ৫ শতাংশ বেড়ে এ বছর তার বেতন হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া ২৫ হাজার টাকা, বাড়িতে বাবা-মাকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর বাকি ১০ হাজার টাকায় তাকে খাবার, সন্তানের পড়াশোনা, নিজের যাতায়াতসহ বাকি সব খরচ মেটাতে হয়। গত বছরের শুরুর দিকেও মোটামুটিভাবে চলতে পারতাম। কিন্তু এই এক বছরে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। অফিসে যাতায়াত করি বাসে। সেই ভাড়াও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নিজের কষ্টের কথা তো আর কাউকে বলতে পারি না, সহ্যও করতে পারছি না আর। খাবারের খরচও অনেক কমিয়ে ফেলতে হয়েছে, অন্যান্য খরচের কথা তো বাদই দিলাম।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবীদের তো আর আয় বাড়ছে না। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। এর বাইরে যারা আছেন তারা হয়তো তাদের পণ্য বা সেবার দাম বাড়িয়ে কিছুটা সমন্বয়ের সুযোগ পান। যাদের সমন্বয়ের সুযোগ আছে তাদের আয়ও যে অনেক বেড়েছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দাম বাড়ালেও তাদের আয় সার্বিকভাবে হয়তো কমছে। একজন মাছ বিক্রেতা ১০ টাকার মাছ হয়তো ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। কিন্তু তার মোট বিক্রি তো কমে গেছে। আসলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগকারীদের জন্যও ভালো না, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের জন্যও খারাপ এবং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাও কমায়। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে ফিসক্যাল পলিসি, মনিটরি পলিসির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে হবে। স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে সবার আগে প্রান্তিক মানুষের জন্য কম দামে নিত্যপণ্য বিক্রি কার্যক্রম আরো বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে, ম্যাক্রো ইকোনমি আরো শক্তিশালী করতে হবে। আমদানি বা উৎপাদন থেকে ক্রেতার হাত পর্যন্ত পণ্য পৌঁছাতে নানাভাবে বাজারে কারসাজি হচ্ছে। সেখানে শক্ত নজরদারি প্রয়োজন।