ইসলামী শিক্ষার সহযাত্রায় সূচনা হয়েছিল ইসলামী সভ্যতার। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ইসলামী বিদ্যাপীঠ তথা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মক্কা নগরীর সাফা পর্বতের পাদদেশে সাহাবি আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর বাড়িতে। এরপর নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদ-ই-নববীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় সুফফা নামক শিক্ষালয়। এটাই ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আবাসিক মাদরাসা।
এর পর থেকে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষা ছিল মসজিদভিত্তিক। শহরের প্রধান প্রধান মসজিদে বিশিষ্ট মনীষীরা পাঠদান করতেন। এর বাইরে বিশিষ্ট আলেমদের বাড়িতেও পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল। তবে এ দুটির কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ আবাসিক মাদরাসা ছিল না।
পূর্ণাঙ্গ আবাসিক মাদরাসার সূচনা
হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে সেলজুক প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক তুসি (রহ.) বাগদাদে মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ আবাসিক মাদরাসা, যা মসজিদ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না। শিক্ষাক্রম, শিক্ষার মান, বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের সমাবেশ, আবাসিক সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় এটা আধুনিক যুগের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য ছিল। অবশ্য তার আগেও আবাসিক মাদরাসার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেগুলো হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল, নয়তো বিশেষায়িত ছিল। যেমন—
দারে ইমাম আবু হাতিম (রহ.)
ইমাম আবু হাতিম (রহ.) ৩৪৫ হিজরিতে ‘বাস্ত’ শহরে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তাঁর বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে শিক্ষার্থীদের আবাসিক থাকার ব্যবস্থা ছিল। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ ছিল। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ পাঠাগারে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করত।
মাদরাসায়ে নিশাপুর
৩৪৯ হিজরিতে ইমাম নিশাপুরি (রহ.) নিশাপুরে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এখানে সামগ্রিক ইসলামী জ্ঞানের পাঠ ছিল না। প্রধানত হাদিস ও ফিকহে শাফেয়ির পাঠদান করা হতো।
মাদরাসায়ে হুসাইনি
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবু আলী হুসাইনি (রহ.) ৩৯৩ হিজরিতে ইলমে হাদিসের পাঠদানের জন্য বিশেষায়িত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সমবেত হয়েছিল।
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হিজরি চতুর্থ শতকেই স্বতন্ত্র আবাসিক মাদরাসার ধারণা বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তা আংশিকভাবে হলেও বিকশিত হতে থাকে।
মাদরাসাপূর্ব ইসলামী শিক্ষা
ইসলামের সূচনাকাল থেকেই জ্ঞানচর্চা ছিল, তবে পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আগে ইসলামী শিক্ষা ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। মসজিদেই পাঠদানের আসর হতো। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করত, পরস্পর আলোচনা করত, শিক্ষককে প্রশ্ন করে জেনে নিত। মসজিদের মুসল্লিরাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই উপস্থিতি মেনে নিত। কোনো কোনো মসজিদে জ্ঞানচর্চাকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো। যেমন— আল-আজহার মসজিদে শুধু জুমার নামাজে সাধারণ মুসল্লি একত্র হতো। অন্য সময় শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই নামাজ আদায় করত।
স্বতন্ত্র মাদরাসা কেন প্রয়োজন
দিন দিন মসজিদে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়ছিল। ফলে নির্বিঘ্নে ইবাদত করার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল, যা সাধারণ আবেদ ও মুসল্লিরা অপছন্দ করছিল। এ ছাড়া ইসলামী জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটায় জাগতিক এমন অনেক বিষয় তাতে যুক্ত হচ্ছিল, যার চর্চা অনেকের কাছেই ইবাদত বলে গণ্য হচ্ছিল না। যেমন—যুক্তি ও তর্ক বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত ইত্যাদি। ফলে শিক্ষার আধুনিকায়ন, মসজিদের পরিবেশ রক্ষা ও সমন্বিত শিক্ষাক্রম তৈরির স্বার্থে স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক ছিল।
স্বতন্ত্র মাদরাসার বৈশিষ্ট্য
মসজিদ থেকে পৃথক হয়ে যেসব স্বতন্ত্র আবাসিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোর কয়েকটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
১. বিস্তৃত সিলেবাস : স্বতন্ত্র আবাসিক মাদরাসাগুলো সর্বপ্রথম সমকালীন জাগতিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
২. আবাসিক ব্যবস্থা : এসব মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুযোগ-সুবিধা ছিল, যা মসজিদে নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না।
৩. শিক্ষকের দায়বদ্ধতা : স্বতন্ত্র আবাসিক মাদরাসায় নিযুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগই দেওয়া হয়েছিল পাঠদানের জন্য, তাই তাঁদের দায়বদ্ধতা ছিল। অন্যদিকে মসজিদে যাঁরা পাঠদান করতেন, তাঁদের বেশির ভাগই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনা মূল্যে পাঠদান করতেন।
৪. শিক্ষা উপকরণের সহজলভ্যতা : ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগের প্রায় সব আবাসিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে স্থানীয় শাসকদের ভূমিকা ছিল। তাঁরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। যেমন—বেশির ভাগ মাদরাসারই নিজস্ব সুবিশাল পাঠাগার ও অধ্যয়ন কক্ষ ছিল।
নিজামুল মুলকের অবদান
স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় নিজামুল মুলক তুসি (রহ.)-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল জ্ঞানী ও পণ্ডিতরা যেন একাগ্র মনোযোগে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। তিনি সাম্রাজ্যের বড় বড় শহর যেমন—ইস্পাহান, নিশাপুর, বলখ, হিরাত, বসরা, বাগদাদ ইত্যাদি শহরে একাধিক মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসার নাম রাখেন নিজামিয়া। প্রত্যেক মাদরাসার জন্য আবাসিক হল, স্থায়ী সম্পদ ও নগদ অর্থের ব্যবস্থা করেন।
শ্রেষ্ঠ নিজামিয়া মাদরাসা
মাদারেসে নিজামিয়ার মধ্যে নিজামিয়া বাগদাদ সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও বিখ্যাত ছিল। নিজামিয়া বাগদাদের নির্মাণকাজ জিলকদ ৪৫৭ হিজরিতে শুরু হয়েছিল। দুই বছর নির্মাণকাজ চলে। শনিবার ১০ জিলকদ ৪৫৯ হিজরিতে শুভ উদ্বোধন হয়। মাদরাসার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন শায়খ আবু মানসুর বিন ইউসুফ (রহ.)।
পর্যটক ইবনে বতুতা ৫৮১ হিজরিতে এই মাদরাসা দেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে লিখেছেন যে নিজামুল মুলক মাদরাসা নির্মাণে দুই লাখ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেছেন এবং প্রতিবছর ছাত্রদের পড়ালেখা, খাবার ও আবাসনের প্রয়োজন মেটাতে ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা খরচ করতেন। এখানে ছয় হাজার ছাত্র ফিকহ, তাফসির, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিভাগে লেখাপড়া করত। তিনি মাদরাসার যাবতীয় খরচ বহন করতেন। মাদরাসার বেতন স্কেল অনুযায়ী গ্রন্থগারিক প্রতি মাসে ১০ স্বর্ণ মুদ্রা বেতন পেতেন। মাদরাসা নিজামিয়া বাগদাদের গ্রন্থগার প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগে ছিলেন জগদ্বিখ্যাত আলেম ও সাহিত্যিক খতিবে তিবরিজি (রহ.)। তিনি কিছুদিন পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেন।