দেশে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে চালু হচ্ছে মেট্রোরেল। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে এটি। ইতোমধ্যে ভাড়ার হার প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, ভাড়ার হার তুলনামূলক বেশি। বিভিন্ন সংগঠন থেকেও ভাড়া কমানোর দাবি জানানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এক বিজ্ঞপ্তিতে মেট্রোরেলের ভাড়ার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া পাঁচ টাকা। এছাড়া সর্বনিম্ন ২০ এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা। এ ভাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লি থেকে প্রায় দ্বিগুণ এবং কলকাতার চেয়ে তিন গুণ বেশি। এছাড়া পাকিস্তানের লাহোরের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি।
তালিকা অনুযায়ী, দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া দিতে হবে ৬০ টাকা। এ দূরত্বে সাতটি স্টেশন রয়েছে। দিয়াবাড়ি থেকে উত্তরা সেন্টার এবং উত্তরা সাউথ স্টেশনের ভাড়া ২০ টাকা। এটি মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া। এছাড়া দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী ও মিরপুর- ১১ স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা।
মেট্রোরেলের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া পাঁচ টাকা। এছাড়া সর্বনিম্ন ২০ এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা। এ ভাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লি থেকে প্রায় দ্বিগুণ এবং কলকাতার চেয়ে তিন গুণ বেশি। এছাড়া পাকিস্তানের লাহোরের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি
আবার পল্লবী থেকে মিরপুর- ১১ বা কাজীপাড়া স্টেশনে নামলেই ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। তবে, পল্লবী থেকে শেওড়াপাড়া বা আগারগাঁও পর্যন্ত যেকোনো স্টেশনে নামলে ভাড়া দিতে হবে ৩০ টাকা।
মিরপুর-১০ থেকে ফার্মগেট ৩০ টাকা, কারওয়ান বাজার ৪০ টাকা, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ৫০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। একই দূরত্ব থেকে সচিবালয় বা মতিঝিল পর্যন্ত যেতে লাগবে ৬০ টাকা। তবে, কমলাপুর পর্যন্ত যেতে আরও ১০ টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে।
ফিরতি পথে কমলাপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেকোনো স্টেশনে ২০ টাকা, শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার ৩০ টাকা, ফার্মগেট ৪০ টাকা, বিজয় সরণি ও আগারগাঁও ৫০ টাকা, শেওড়াপাড়া ৬০ টাকা, কাজীপাড়া ও মিরপুর- ১০ স্টেশন পর্যন্ত ৭০ টাকা, মিরপুর- ১১ ও পল্লবী ৮০ টাকা এবং উত্তরার সাউথ স্টেশন পর্যন্ত ৯০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দিয়াবাড়ি তথা উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের ভাড়া ১০০ টাকা।
দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া দিতে হবে ৬০ টাকা। এ দূরত্বে সাতটি স্টেশন রয়েছে। দিয়াবাড়ি থেকে উত্তরা সেন্টার এবং উত্তরা সাউথ স্টেশনের ভাড়া ২০ টাকা। এটি মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া। এছাড়া দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী ও মিরপুর- ১১ স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা
স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করলে ১০ শতাংশ ছাড়ের সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। এছাড়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিনা মূল্যে মেট্রোরেলে ভ্রমণ করতে পারবেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রতিবার ভ্রমণে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা পাবেন।
সাধারণ মানুষ যা বলছেন
মোরশেদুল আলম, ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে তিনি বলেন, সব দেশেই মেট্রোরেলের ভাড়া অনেক কম। তবে, আমাদের দেশে উল্টো চিত্র৷ উত্তরা থেকে মতিঝিলের ভাড়া ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা তুলনামূলক বেশি৷ এ রুটের ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০ টাকা হওয়া উচিত। এছাড়া সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকাও আমার কাছে অনেক বেশি মনে হচ্ছে। এটা ১০ টাকা হওয়া উচিত।
শিমুল নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, মেট্রোরেলের ভাড়া অনেক বেশি হয়ে গেছে। প্রতি কিলোমিটার পাঁচ টাকা, যা বাসের চেয়ে বেশি। এটি দুই থেকে সাড়ে তিন টাকা হলে কোনো আপত্তি থাকত না। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হলে সঠিক হতো।
কামরুজ্জামান নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, এ ভাড়া নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য অনেক বেশি। তাই সরকারের উচিত ভাড়া আরও কমানো।
মোহাম্মদ জহির নামের অপর এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উত্তরা থেকে মতিঝিল ১০০ টাকা দিয়ে যাবে না। মেট্রোরেল বড়লোকদের পরিবহন হতে যাচ্ছে!
মেট্রোরেলের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া দুই থেকে তিন টাকা এবং সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হওয়া উচিত বলেও মত দেন তিনি।
ভাড়া পুনর্বিবেচনার দাবি
করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার এ সময়ে এসে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে ভাড়া পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে ‘সেভ দ্য রোড’ নামের সংগঠন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমানুষের কল্যাণের জন্য যে মেট্রোরেলের ব্যবস্থা করলেন, সেই মেট্রোরেলে যেন জনগণ উঠতে না পারে সেজন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর তা দিতেই সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, তখন এর চেয়ে বেশি ভাড়া নির্ধারণ করলে তা তাদের ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে গণ্য হবে।
এতে বলা হয়, মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত তিন সদস্যের একটি পরিবারের যেখানে মাসিক ব্যয় কমপক্ষে ২১ হাজার টাকা, সেখানে নতুন করে মেট্রোরেল তার জীবনে নতুন কোনো আশার সঞ্চার করতে পারেনি। এ অবস্থায় একজন মধ্য মাপের চাকরিজীবীর বেতন যেখানে ১৮-২০ হাজার টাকা, তার বেতন থেকে মেট্রোরেলে আসা-যাওয়ার জন্য গুনতে হবে কমপক্ষে দুই হাজার ৪০০ টাকা। বাকি টাকায় পরিবার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হবে।
মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ হওয়া উচিত ১৪ টাকা— উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া সাড়ে তিন টাকা হতে পারে। একই সঙ্গে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া সর্বোচ্চ ৬০ টাকা নির্ধারিত হলে প্রমাণিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের কথা ভাবছে সরকার।
বিদেশের সঙ্গে তুলনার পক্ষে নন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এআরআই পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, অন্য দেশের মেট্রোরেলের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, প্রতিটা শহরে মেট্রোর ভাড়া নির্ধারণের সময় ভর্তুকির বিষয়টি থাকে। একেক দেশের সরকার ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে একেক রকম কৌশল অবলম্বন করে।
‘কলকাতার মেট্রোরেলের কথা বলা হচ্ছে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালে। কলকাতা মেট্রোর অপারেটিং রেশিও এ মুহূর্তে প্রায় ২৪০ হবে। তার মানে ১০০ টাকা আয় করছে এবং তার বিপরীতে ২৪০ টাকা খরচ হচ্ছে। ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১৪০ টাকা। ব্যাপারটা হচ্ছে একেক দেশের মেট্রোর জন্য ভর্তুকির স্ট্রাকচার একেক রকম।’
হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে ভর্তুকি কত, সেটা কিন্তু আমরা জানি না। বাসের সঙ্গে মেট্রোরেলের হিসাবটা একেবারেই সহজ। আমাদের যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসগুলো ঢাকা শহরে চলে, যদি ধরি বাসগুলো প্রতি কিলোমিটারে প্রতি মাসে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ১০০ টাকা, সেখানে মেট্রোরেলের এ ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। ঢাকা শহরে যে এসি বাসগুলো চলে সেখানে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭০ টাকা। এছাড়া নন-এসি বাসে পরিচালন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নাই বললেই চলে। ন্যূনতম ব্যয় দিয়ে তারা চালাচ্ছে। মেট্রোরেলের এ ব্যয়টা অনেক বেশি। এ কারণে ভাড়ার তালিকাটি এমন।’
এক্ষেত্রে সময় সাশ্রয়ের বিষয় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধরুন, আমি উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাওয়ার জন্য একজনকে খুব সুন্দর একটি পরিবহনে তুলে দিলাম এবং বললাম, গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে একদিন। সে কিন্তু যাবে না। কারণ, তার সময় বেশি লাগবে। তার মানে সময়ের একটা দাম আছে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে সময় সাশ্রয়ের বিষয় আছে।’
নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য দিতে হবে বিশেষ ছাড়
তবে, নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে নির্ধারিত ভাড়া কিছুটা বেশি হয়েছে বলে স্বীকার করেন মো. হাদিউজ্জামান। এজন্য তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। বলেন, ‘তাদের জন্য ভাড়াটা বেশি হয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। ভাড়ার বিষয়টা অত্যন্ত জটিল। এটা যদি কমাতে হয় সরকারকে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হবে। এ ভর্তুকি সরকার যখন দেবে, ধনীরাও কিন্তু পাবে। কারণ, ভাড়া তো সবার জন্যই কমিয়ে দেওয়া হলো।’
‘ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, যারা মেট্রোতে চড়বেন না তাদের কাছ থেকেও ভর্তুকি যাবে। কারণ, সরকার তো ব্যবসা করে না। ভর্তুকির জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবে। তখন সর্বোপরি এটা জনগণের ওপর পড়বে।’
উন্নত অনেক দেশ আছে যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বিশেষ ছাড় থাকে— উল্লেখ করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘যাদের বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম আয় তাদের ভাড়ার ওপরে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। এটা করা যেতে পারে।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ধরুন, যাদের মাসিক আয় ১৫ বা ২০ হাজারের কম, তাদের ক্ষেত্রে এটা করা যেতে পারে। এজন্য তাদের আবেদন করতে হবে। যেটা উন্নত দেশে আছে। এরপর কর্তৃপক্ষ তথ্য যাচাই করে ১০ বা ১৫ শতাংশ ছাড় দিতে পারে।’
ভিন্ন মত থাকতেই পারে : ওবায়দুল কাদের
মেট্রোরেলের যে ভাড়া ঘোষণা করা হয়েছে, তা তুলনামূলক বেশি বলছেন অনেকে। ভাড়া পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না—জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি কে বলেন, ‘ভিন্ন মত থাকতেই পারে। যখন বাস্তবে তারা (যারা ভাড়া বেশি বলছেন) মেট্রোরেলে আসা-যাওয়া করবেন; তিন মিনিট পর এক স্টেশন, এ বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন এবং ৪০ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন; তখন তারা এটা সহজভাবে নেবেন বলে আমরা আশা করি।’