এটা খুবই স্বাভাবিক ও সংগত কথা, যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছিলেন সর্বপ্রথম তিনি তাঁদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। এ দলের মধ্যে ছিলেন পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। অধিকন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ওই সব লোককে সত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন, যাঁদের মুখমণ্ডলে কল্যাণ এবং সত্য-প্রীতির আভাস ছিল সুস্পষ্ট। তা ছাড়া যাঁরা নবী করিম (সা.)-এর সততা, সত্যবাদিতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সুবিদিত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁর প্রতি এত বেশি অনুরক্ত ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে প্রথম আহ্বানেই সাড়া দিয়ে তাঁরা ইসলাম কবুল করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার এক দুর্লভ গৌরব অর্জন করেন।
এঁদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন উম্মুল মুমিনিন নবীপত্নী খাদিজাতুল কোবরা (রা.) বিনতে খুওয়াইলিদ, তাঁর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ক্রীতদাস জায়দ বিন হারিসা (রা.), তাঁর চাচাতো ভাই আলী বিন আবু তালিব—যিনি তখনো তাঁর লালন-পালনাধীন শিশু ছিলেন এবং তাঁর সাওর গুহার সঙ্গী আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। এঁরা সবাই প্রথম দিনেই মুসলিম হয়েছিলেন। (রহমাতুল্লিল আলামিন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০)
এরপর আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রচারকাজে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কোমল স্বভাব, পছন্দনীয় অভ্যাসের অধিকারী, সচ্চরিত্র এবং দরাজ দিল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দানশীলতা, দূরদর্শিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সৎ সাহচর্যের কারণে তাঁর কাছে লোকজনের গমনাগমন প্রায় সব সময় লেগেই থাকত। পক্ষান্তরে তিনি তাঁর কাছে আগমন ও প্রত্যাগমনকারী এবং আশপাশে বসবাসকারীদের মধ্যে যাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন তাঁর সামনেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উসমান (রা.), জোবায়ের (রা.), আবদুর রহমান বিন আওফ (রা.), সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) এবং তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ মহা সম্মানিত ব্যক্তিরাই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠী।
প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন বিলাল হাবশি (রা.)-ও ছিলেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এরপর ইসলাম কবুল করেন বনু হারিস বিন ফিহর গোত্রের আবু উবায়দাহ আমির বিন জাররা (রা.), আবু সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখজুমি (রা.), আরকাম বিন আবিল আরকাম (রা.), উসমান বিন মাজউন জুমাহি (রা.) এবং তাঁর দুই ভাই যথাক্রমে কুদামা ও আবদুল্লাহ (রা.), উবায়দাহ বিন হারিস বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ (রা.), সাঈদ বিন জায়দ (রা.) এবং তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ ওমর (রা.)-এর বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব (রা.), খাব্বাব বিন আরাত তামিমি (রা.), জাফর বিন আবু তালিব (রা.) ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়স (রা.), খালিদ বিন সাঈদ (রা.) ও তাঁর স্ত্রী আমিনা বিনতে খালাফ (রা.), অতঃপর তাঁর ভাই আমর বিন সাঈদ বিন আস (রা.), হাতিব বিন হারিস জুমাহি (রা.) ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিনতে মুখাল্লিল (রা.) ও তাঁর ভাই খাত্তাব বিন হারিস (রা.) এবং তাঁর স্ত্রী ফুকাইহাহ বিনতে ইয়াসার ও তাঁর ভাই মামার বিন হারিস (রা.), মুত্তালিব বিন আজহার জুহরি (রা.) ও তাঁর স্ত্রী রামলাহ বিনতে আবু আওফ (রা.), নাঈম বিন আবদুল্লাহ বিন নুহাম আদবি (রা.)। তাঁদের সবাই কুরাইশ ও কুরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্রের।
কুরাইশ ছাড়া অন্য গোত্র থেকে প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারীরা হলেন আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.), মাসউদ বিন রাবিআহ (রা.), আবদুল্লাহ বিন জাহশ আসাদি (রা.) ও তাঁর ভাই আহমাদ বিন জাহশ (রা.), বিলাল বিন রিবাহ হাবশি (রা.), সুহাইব বিন সিনান রুমি (রা.), আম্মার বিন ইয়াসার আনসি (রা.), তাঁর পিতা ইয়াসার ও তাঁর মাতা সুমাইয়া এবং আমির বিন ফুহাইরাহ।
ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলিম নারীদের মধ্যে ছিলেন উম্মু আইমান বারাকাত হাবশি (রা.), উম্মুল ফজল লুবাবাতুল কুবরা বিনতে হারিস হিলালিয়াহ (রা.) (আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী) ও আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক (রা.)।
উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীর গুণে গুণান্বিতদের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে ৩৩০ জন। তবে এটা অকাট্যভাবে জানা যায়নি যে তাঁরা প্রকাশ্যে দাওয়াত চালু হওয়ার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, নাকি ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যভাবে চালু হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করেছিলেন।