একটি জাতির উত্থানে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ইতিহাস অতীতের জাতি ও গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার নির্যাস। এর আলোকে বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যতের দিশা নির্ধারণ করতে পারে। যে জাতি নিজের অতীত-ইতিহাস বিস্মৃত হয়, পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে। ইতিহাসের মৌলিক উদ্দেশ্য—অতীতকালীন ঘটনাবলি থেকে উপদেশ গ্রহণ করা এবং সেকালের মানুষদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের জীবনে কাজে লাগানো।
কোরআনের বর্ণনায় ইতিহাসের গুরুত্ব
ইতিহাসের গুরুত্বের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে কোরআনের মৌলিক পাঁচটি বিষয়বস্তু থেকে অন্যতম একটি হলো পূর্ববর্তীদের ইতিহাস বর্ণনা। যদিও কোরআন কোনো ইতিহাস-সংকলন নয়; বরং তা মানবজাতির পথপ্রদর্শনের নিমিত্তে অবতীর্ণ আসমানি কিতাব। তবে তাতে ইতিহাসের ততটা আলোচনা করা হয়েছে, যা দ্বারা মানুষ হিদায়াত লাভ করতে পারে। কোরআনে অসাধারণ বাগ্মিতাপূর্ণ ভাষায় সংক্ষিপ্তভাবে পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যাতে সত্যান্বেষীরা উজ্জীবিত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আগে যা ঘটেছে তার কিছু সংবাদ এভাবেই আমি তোমার কাছে বর্ণনা করি। আর তোমাকে আমার পক্ষ থেকে উপদেশ দান করেছি। ’ (সুরা ত্বহা : আয়াত ৯৯)
তদ্রুপ বিভিন্ন জাতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যেন তাদের পরিণতি থেকে সবক নেওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে : ‘তাদের কাহিনিতে বুদ্ধিমানদের জন্য আছে শিক্ষণীয় উপাদান…। ’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১১১)
ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহ গ্রহণে ইসলামের নির্দেশনা
প্রাচীন যুগ থেকেই পূর্ববর্তীদের কাহিনির চর্চা আছে। তবে ইসলাম ইতিহাস বর্ণনা ও সংকলনের নীতি শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম ইতিহাসের বর্ণনাকে অবাধভাবে গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছে; বরং যাচাই-বাছাই করে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। ইরশাদ হয়েছে : ‘হে ঈমানদাররা, যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা যাচাই করে নাও। ’ (সুরা হুজুরাত : আয়াত ৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট যে সে যা-ই শুনে যাচাইবিহীন তা-ই রটাতে থাকে। ’ (মুসলিম : ১/১০)
এ শিক্ষাও দিয়েছে যে ইতিহাস সত্তাগতভাবে মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষাগ্রহণ। ইরশাদ হয়েছে : ‘আমি রাসুলদের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলেছি, যা দ্বারা তোমার অন্তরকে করেছি সুসংহত। আর এতে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য উপদেশ ও স্মরণ। ’ (সুরা হুদ : আয়াত ১২০)
ইতিহাসশাস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থান
ইতিহাসশাস্ত্রের অসামান্য গুরুত্ব সত্ত্বেও তার দ্বারা আকিদা বা বিধানাবলি প্রমাণিত হবে না। হালাল-হারাম বিষয়ক ফায়সালা, তদ্রুপ যেসব বিষয়াদিতে কোরআন-সুন্নাহ বা ইজমা-কিয়াস ইত্যাদির প্রমাণ প্রয়োজন সেখানে ইতিহাসশাস্ত্রের একচ্ছত্র গ্রহণযোগ্যতা কেউই স্বীকার করেনি। কারণ যদিও ইসলামী ইতিহাসের উৎসগুলো প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের গল্পের মতো ঠুনকো ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং অনেকটা যাচাই-বাছাইয়ের পর্ব শেষেই ইতিহাসগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তা সত্ত্বেও ইতিহাসগ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে ইসলামের আকিদা, বিধি-বিধান ও মূলনীতি প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের গ্রহণযাগ্য দলিলের প্রয়োজন ওই পর্যায়ের যাচাই-বাছাই ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূূহে সাধারণত বিবেচ্য হয়নি। (মাকামে সাহাবা, মুফতি শফি পৃষ্ঠা ৩১-৩৩)
ইতিহাস ও হাদিসবর্ণনার তফাত
ইসলামে কোরআন ও বিশাল জামাতের অবিচ্ছিন্নসূত্রে যুগপরম্পরায় বর্ণিত হাদিসের যে গ্রহণযোগ্যতা, তা সাধারণ দু-চারজনের বর্ণিত হাদিসের ক্ষেত্রে নেই। তদ্রুপ হাদিসের যে মর্যাদা, সাহাবিদের বাণীর মর্যাদা তার চেয়ে নিম্নতর। তেমনি হাদিসের যে গ্রহণযোগ্যতা, ঐতিহাসিক বর্ণনার ওই গ্রহণযোগ্যতা নেই। এ জন্যই কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা যদি কোরআন-হাদিস বা শরিয়তের স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে ঐতিহাসিক বর্ণনাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হবে, নতুবা প্রত্যাখ্যাত হবে। (উসুলুল জাসসাস ৩/১৭২)
ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহ ও সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতা
ইতিহাসগ্রন্থে সাহাবিদের মর্যাদাহানিকর কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো, সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমার ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তাঁদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা, সন্তুষ্টি ও জান্নাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাই শুধু ইতিহাসের বর্ণনার ভিত্তিতে কোনো সাহাবির ব্যাপারে মর্যাদাহানিকর কথাবার্তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ইতিহাসগ্রন্থসমূহে অনেক দুর্বল-অশুদ্ধ ও জাল বর্ণনার ছড়াছড়ি রয়েছে। তাই শুধু ইতিহাসের বর্ণনা দ্বারা কোনো সাহাবির ন্যায়পরায়ণতা পরীক্ষা করা যাবে না; বরং ওই ঐতিহাসিক বর্ণনাটির গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য।
কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সবাই একমত যে সাহাবাদের পরিচয় ও তাঁদের পরস্পর বিবদমূলক বর্ণনাসমূহ ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়; বরং তাঁদের পরিচয়সংক্রান্ত বিষয় হাদিসশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁদের ফজিলত ও পরস্পর বিবদমূলক বর্ণনাসমূহ আকিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতএব এসব বিষয়ের ফায়সালার জন্য কোরআন-হাদিস ও ইজমার দলিল প্রয়োজন। শুধু ইতিহাসের কিতাব দেখেই ফায়সালা করা যাবে না। (আলআকিদাতুল ওয়াসিতিয়া, ইবনে তাইমিয়া, পৃষ্ঠা ২৬, মাকামে সাহাবা, পৃষ্ঠা ৩৪)
ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলিমদের ইতিহাস
নবীজীবনী ও সাহাবিদের জীবনীকে নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু তৎপরবর্তী মুসলিমদের ইতিহাস ধর্মের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও পরবর্তী যুগে ধর্মীয় বহু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইসলামের প্রসার, অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার এবং মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্য পরিচালনাসহ মুসলমানদের বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পারস্পরিক সংঘাত, পাপাচারী ও অত্যাচারী বাদশাহদের ইতিবৃত্ত ধর্মীয় ইতিহাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। এটাকে মুসলিমদের ইতিহাস বলা যায়, যেখানে তাদের উত্থান-পতন এবং কখনো তাদের ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ফুটে ওঠে, আবার কখনো দূরত্ব। তাই ইসলামের ইতিহাস হিসেবে সংকলিত গ্রন্থগুলোকে মুসলিম জাতির ইতিহাস হিসেবে অধ্যয়ন করা উচিত, ইসলাম ধর্মের ইতিহাস হিসেবে নয়। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৪৩)
নামসর্বস্ব নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ বনাম ইনসাফপূর্ণ ইতিহাস
আধুনিক যুগে ইতিহাসের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণভিত্তিক ইতিহাস সংকলনের ধারা আছে। তবে এটা সত্য যে পক্ষপাতমুক্ত হয়ে কাজ করা খুবই দুরূহ। সাধারণত, বুদ্ধিবৃত্তিক সংকলনের নামে নিজের অভিরুচি ও দৃিষ্টভঙ্গি অনুসারে কোনো বিশেষ তত্ত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অতএব বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার নামে সর্বসম্মত বিশুদ্ধ বর্ণনা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তাই ইসলাম ইনসাফপূর্ণ ইতিহাস বিশ্লেষণের শিক্ষা দিলেও এ জাতীয় স্বাধীন বিশ্লেষণের অনুমতি দেয় না। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৪৭)
ইতিহাস অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সচেতন পাঠকের দায়িত্ব
যেকোনো ভালো জিনিসের নিয়মবহির্ভূত ব্যবহার ক্ষতির কারণ হয়। ইতিহাসশাস্ত্রেরও বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। এর যথাযথ বিবেচনা না করার ফলে বহু ইতিহাস পাঠকের মধ্যে নিজেদের অতীত নিয়ে হীনম্মন্যতা ও পূর্বসূরিদের ব্যাপারে ভুলধারণার জন্ম নিতে দেখা যায়। অনেকে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত ইতিহাস ও ইতিহাস-দর্শন অধ্যয়নে অভ্যস্ত; তারা মুসলিম ইতিহাসবিদদের অনুসৃত মূলনীতি সম্পর্কে অবগত থাকে না। স্বভাবতই যেকোনো শাস্ত্র নিয়মবহির্ভূত পদ্ধতিতে অধ্যয়ন করলে তা থেকে ভ্রান্তির জন্ম নেবে।
তাই নিম্নোক্ত বিষয়াদি লক্ষ রাখা অপরিহার্য :
* ইসলামী শরিয়তের আকিদা, বিধি-বিধান ও মূলনীতি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা।
* ইসলামী শরিয়তের মৌলিক উৎস ও দলিলের ওপর প্রাধান্যমূলক সর্বোচ্চ আস্থা রাখা।
* নবীদের মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন থাকা।
* সাহাবিদের মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতনতা।
* যেসব বর্ণনায় ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সালাফদের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, সেগুলোকে ঢালাওভাবে গ্রহণ না করে সচেতনতার সঙ্গে গ্রহণ করা।
* ব্যক্তির ভুল ও মন্দ দিক এবং ইসলাম ধর্মের পার্থক্য বিষয়ক সচেতনতা।
* ভ্রান্ত আকিদাপন্থী লেখকের গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন থাকা। ইতিহাসের বিভিন্ন উৎস ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারী বর্ণনাকারীরা কায়দামতো নিজেদের মনগড়া বর্ণনা জুড়ে দিয়েছে। বিচক্ষণ আলেমরা ছাড়া অন্যরা সহজে এসব ধরতে পারে না।
* অমুসলিম ও প্রাচ্যবিদদের গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা। বহু ইতিহাস অধ্যয়নকারী আরবি ও ফারসি জানা না থাকায় ইতিহাসের মূল উৎসগ্রন্থগুলো পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেন না। তাদের বাংলা-ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে শাস্ত্রীয় গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হয় না। ইংরেজিতে অভ্যস্ত হওয়ায় বেশির ভাগ লোক ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য প্রাচ্যবিদদের রচিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করে, যেখানে শাস্ত্রীয় গবেষণার নামে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষবাষ্প ছড়ানো হয়।
* ইতিহাসের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার নামে সর্বসম্মত বিশুদ্ধ বর্ণনা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
* ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে শরিয়তের সর্বসম্মত বিশুদ্ধ বিষয়াদিতে মনে প্রশ্ন এলে তা বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধা করার চেষ্টা করবে।
(মানহাজু কিতাবাতিত তারিখ, ড. মুহাম্মাদ ইবনে শামেল, পৃষ্ঠা ৫০৯)