বর্তমান যুগে রোবটের সঙ্গে মানুষের খেলাধুলা করা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন উন্নত দেশ এমন অনেক রোবট তৈরি করেছে, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিভিন্ন খেলায় পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম। কিন্তু আজ থেকে ২৫০ বছর আগে যদি এমন কোনো রোবট আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা জানা যায়, যে রোবট দক্ষ দাবা খেলোয়াড় ছিল, তা অবশ্যই বিস্ময়কর ঘটনা। এমনই একটি রোবট আবিষ্কৃত হয়েছিল আজ থেকে ২৫৩ বছর আগে। যার নাম ছিল, ‘আয়রন মুসলিম’ বা ‘অটোমান তুর্ক’। রোবটটি দাবা খেলায় পারদর্শী ছিল।
যেভাবে রোবটটি তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয় : রোবটটি তৈরির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, মূলত এর জনপ্রিয়তা থেকে। খেলাটি সে সময় বিশ্বব্যাপী দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানেও বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা দাবা। এমনও দেশ আছে, যেখানে দাবা খেলা স্কুল থেকেই বাধ্যতামূলক, এমনও দেশ আছে যেখানে দাবাড়ুরাই দেশের সবচেয়ে বড় তারকা। ইউরোপের আর্মেনিয়া এমনই এক দেশ, যেখানে ছয় বছরের ওপর সব শিশুকেই দাবা খেলা শেখানো হয়।
চীনে বিভিন্ন পার্কে দাবার ছক সাজিয়ে রাখা হয়। নিউ ইয়র্ক সিটির অনেক পার্কেও এমনটা দেখা যায়। ৬৪ বর্গক্ষেত্র ও ৩২ গুটির এই খেলাটি আকারে ছোট মনে হলেও এর প্রতিটি ধাপই ধারণাতীত এবং সহস্রাধিক ফলাফলের সম্ভাবনা ধারণ করে।
ধারণা করা হয়, খেলাটির উৎপত্তি ভারতবর্ষে কিংবা পারস্যে। কেউ আবার দাবি করে, এই খেলাটির উৎপত্তি চীনে। ১৪ শতাব্দীতে ইবনে খালদুন দাবা খেলাটির সঙ্গে সাসসা ইবনে দাহিরের সংযোগ তুলে ধরেছিলেন। ১৪ শতাব্দীর একটি পারস্য পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে, কিভাবে একজন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পারস্য বিচারসভায় এই দাবা নিয়ে আসেন। এখান থেকেই এটি আরবদের দ্বারা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
খেলাটি ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই লেখাটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিল মুসলিমদের মাধ্যমে। আরব গ্র্যান্ড মাস্টাররা দাবার আইন এবং কৌশল সম্পর্কে বহু গ্রন্থ লিখে রেখে গিয়েছিলেন, যা পুরো মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দাবার ইতিহাস, কৌশল, সমস্যা, সব বিষয়ের ওপরই বই লেখা হয়েছিল। ‘দ্য রাইড অ্যাবেস অ্যান্ড হার নানস’ বইটি লেখা হয়েছিল ১৩৭০ সালে এবং এই বইটিই দাবাকে প্রথমবারের মতো বিস্তৃতভাবে বৈশ্বিক পরিচিতি পাইয়ে দেয়। নবম শতাব্দীতে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এবং ফ্যাশন ট্রেন্ড প্রবর্তক জিরআব আন্দালুসিয়ায় দাবা খেলাটি নিয়ে আসেন। ‘চেকমেট’ মূলত ফারসি ভাষার ‘শাহমাত’ শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ রাজা পরাজিত হয়েছে। আন্দালুসিয়া থেকে এই খেলাটি খ্রিস্টান, স্প্যানিশ, মোজারাবদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তর স্পেন থেকে পাইরেনিস ছাড়িয়ে পর্বতমালা পেরিয়ে সাউদার্ন ফ্রান্স পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
১৪ শতাব্দীতে পুরো ইউরোপেই দাবা বেশ পরিচিতি লাভ করে। ১৩ শতাব্দীতে রাজা দশম আলফান্সো যিনি ‘দ্য ওয়াইজ’ নামে পরিচিত ছিলেন; তিনি ‘বুক অব চেস অ্যান্ড আদার গেমস’ বইটি লিখেছিলেন। এরপর যত দিন যেতে থাকে ততই এই খেলার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
রোবট তৈরির ইতিহাস
১৭৬৯ সালে প্রথম রোবট দাবা খেলোয়াড় আবিষ্কৃত হয়। হাঙ্গেরির বিখ্যাত আবিষ্কারক এবং লেখক উলফগ্যাং দ্য কেম্পেলেন তার রানি মারিয়া থেরেসাকে একটি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, রানি মারিয়া থেরেসা দাবা খেলতে খুব পছন্দ করতেন। দ্য কেম্পেলেন থেরেসাকে দাবা খেলার একটি রোবট উপহার দিয়েছিলেন, যার নাম রাখা হয়েছিল ‘আয়রন মুসলিম’। পরবর্তীকালে আয়রন মুসলিমের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অটোমান তুর্ক’, যা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দাবা খেলতে পারত। তৎকালে প্রচুর দক্ষ খেলোয়াড়কে নিমিষেই হারিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল এই রোবট। মাথায় পাগড়ি পরা এই রোবটকে দেখতে মানুষ বহুদূর থেকে উলফগ্যাংয়ের বাসায় আসত। সে সময় এটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল, ৮৫ বছর ধরে ১৫ জন পৃথক পৃথক দাবা খেলোয়াড় এই রোবটের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল।