নরসিংদীতে উয়ারী -বটেশ্বরের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষন জাদুঘর আড়াই হাজার থেকে ৪ হাজার বছর আগের বাংলাদেশের প্রাচীনতম মানুষের গর্ত বসতিসহ (বাড়িঘর সংস্কৃতি) প্রাচীন জনপদ উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর ঐতিহ্য বহন করছে।
নরসিংদীর জেলার বেলাবো ও শিবপুর উপজেলার বেশকিছু এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটিচাপা পড়ে থাকা এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতা বহন করছে। উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ‘ঐতিহ্য অন্বেষন।’
নরসিংদী জেলা সদরের ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেলাবো উপজেলার দুটি গ্রামের নাম উয়ারী-বটেশ্বর। যেখানে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন।
স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি সুধী সমাজের নজরে এনেছিলেন।
১৯৮৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর পরির্দশনে এসে সভ্যতার অনুমান করেছিলে ২০০০ সালে বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় সর্বপ্রথম উয়ারীতে পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়।
২০০০ সাল থেকে ঐহিত্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের তত্বাবধানে পর্যায়ক্রমে খনন কাজের ফলে এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে উপ-মহাদেশের প্রাচীনতম জনবসতির একটি দূর্গ। আড়াই হাজার বছরের পুরনো ইট-সুরকির নির্মিত রাস্তা, আর্য আমলের লৌহ কুঠার, ১৫ সের ওজনের লৌহার হাতুড়ি, ছোটদের ব্যবহার্য মিনি লৌহ কুঠার, ধনুকের গোলক (স্প্রিং বল), পুরা মাটির শিবলিঙ্গ, পুরা মাটির স্ত্রী লিঙ্গ, নকশি প্রস্তর গুটিকার মালাসহ নানা নিদর্শন।
প্রত্ন অঞ্চল টঙ্গিরটেকে ধারাবাহিক উৎখননে নান্দনিক অলঙ্করণ সমৃদ্ধ বৌদ্ধ মন্দির, গর্ভগৃহ, সীমানা প্রাচীরের সন্ধান পাওয়া গেছে। অলঙ্কৃত বিস্তৃত প্রবেশ পথ ছাড়াও মন্দির কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত তিনটি স্তুপের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা ১২শ বছর আগের বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উয়ারী-বটেশ্বর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন মহাজনপদ, রাজধানী ও একটি দুর্গ নগর। ধাপে ধাপে ৫০ টি প্রত্নস্থানে উৎখননে এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, রোলেটেড মৃৎপাত্র, নবযুক্ত মৃৎপাত্র, ধাতব নিদর্শন, স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাঁচের পুতি, পোড়ামাটি ও পাথরের শিল্পবস্তু, বাটখাড়াসহ নানা অমূল্য প্রত্নবস্তু।
এছাড়া চুন-সুরকি নির্মিত রাস্তা, বৌদ্ধ পদ্ম মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারিকার পাশাপাশি ইটনির্মিত একটি বিশেষ অদ্বিতীয় স্থাপত্য বৌদ্ধ কুণ্ড/ পুকুনিয়া আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর উৎখনন শেষে প্রত্নস্থান ও প্রত্নবস্তু দর্শনার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অর্থাভাবে স্থায়ী সংরক্ষণের পূর্ব পর্যন্ত প্রত্মস্থানসমূহ অস্থায়ীভাবে মাটি চাপা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় এবং গবেষণার জন্য প্রত্নবস্তু ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। গবেষণা শেষে তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়। তাই সারা বছর অনেক দেশি বিদেশি পর্যটক উয়ারী-বটেশ্বর পরিদর্শনে এসে কিছুই দেখতে পেতেন না।
পর্যটকদের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে স্থায়ীভাবে উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ‘ঐতিহ্য অন্বেষন।’এরই ধারাবাহিকতায়q উন্মুক্ত জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘরে স্থান পেয়েছে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ টি প্রত্নস্থানে উৎখননে প্রাপ্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নবস্তু। উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রত্নবস্তু ও মডেল, রেপ্লিকা, প্রত্নবস্তুর আলোকচিত্র, বিবরণ, বিশ্লেষণ।
এ ধরনের প্রত্ন জাদুঘর বাংলাদেশে এই প্রথম উল্লেখ করে ঐহিত্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। উয়ারী-বটেশ্বরে এসে পর্যটকদের এখন আর বিমুখ হয়ে ফিরতে হবে না। পর্যটকরা মডেল গর্ত-বসতিতে নেমে ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগের বাংলাদেশ কেমন ছিল তা দেখতে পারবেন। শিশু কিশোররা প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করার অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। সেই সাথে প্রতিঘন্টায় উয়ারী-বটেশ্বর ডকুমেন্টারি ও ধারণকৃত প্রত্ন নাটক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনও প্রত্ন স্থানে পর্যটকদের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এলাকাবাসী জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় খনন কাজ করলে প্রাচীন সভ্যতার আরো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। উয়ারী – বটেশ্বর একটি প্রত্নতত্ত্ব ভিওিক পর্যটন এলাকায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।