*প্রতিবন্ধী ভাতা গিলছে অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা
* গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি
মোস্তাফিজুর রহমান : প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে সু্রক্ষা আইন ২০১৩ প্রণীত হয়। প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার অনন্য দলিল। যা বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫, ১৭,২০, এবং ২৯ সকল নাগরিকের মত সমান সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করেছেন। ২০০ শত টাকা থেকে শুরু করে ২০২৩- ২৪ অর্থবছরে উন্নীত করে ৮৫০ টাকা অনুর্ধ্ব বাড়িয়েছেন। তবে সমাজসেবা অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা এই ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। এর অন্যতম ডিডি আইউব।
ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সমাজসেবা অধিদফতর। পদ-পদবী ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অত্যন্ত কৌশলে ফাইল আটকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত বিভিন্ন সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও অনিয়মকে পুঁজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থে উপপরিচালক আইয়ুব খান নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তার এসব অবৈধ সম্পদের দিকে যাতে কারো নজর না পড়ে সেজন্য তার নিকটাত্মীয়, সিন্ডিকেট সদস্য এবং সহকর্মীদেরও নাম ব্যবহার করেছেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার শ্যামলীর ‘ঢাকা গার্ডেন সিটি’-তে (ঠিকানা: ১/এফ, আদাবর, মেহেদীবাগ, শ্যামলী) ‘হাসনাহেনা (এফ)’ টাওয়ারে আইয়ুব খানের ৩টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের (পার্কিংসহ) সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি ফ্ল্যাট আইয়ুব খান নিজ নামে ক্রয় করেছেন (ফ্ল্যাট নং: এ-২ নং এবং পার্কিং নং: বি-৩৩), বাকি দুইটির মধ্যে একটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নরসিংদী জেলার উপপরিচালক মাসুদুল হাসান তাপস (ফ্ল্যাট নং: ডি-২ নং এবং পার্কিং নং: বি-২৯) এবং অন্যটি আইয়ুব খানের ভাগ্নে মোঃ সোহেল রানার (জাপান প্রবাসী) নামে ক্রয় করা হয়েছে (ফ্ল্যাট নং: বি-৩ নং এবং পার্কিং নং: জি-৩)। এছাড়াও ‘ঢাকা গার্ডেন সিটি’-তে (ঠিকানা: ১/জি, আদাবর, মেহেদীবাগ, শ্যামলী) ‘মাধবীলতা (বি+সি)’ টাওয়ারের ৬ষ্ঠ তলায় আইয়ুব খানের নামে আরও একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের প্রমাণ মিলেছে। যার প্রতিটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মূল্য ১ কোটি টাকা। শুধু ‘ঢাকা গার্ডেন সিটি’ নয়, এভাবে নামে-বেনামে ঢাকাসহ নিজ জেলা কুমিল্লার হোমনায় চোখ ধাঁধানো মার্কেটসহ আইয়ুব খানের বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও কয়েক কোটি টাকা মূল্যে ক্রয়কৃত একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা গার্ডেন সিটিতে ফাঁকা ২টি প্লটের মধ্যে একটি প্লট ক্রয় করার চেষ্টা করছেন আইয়ুব খান।
শুধু ‘ঢাকা গার্ডেন সিটি’ নয়, এভাবে নামে-বেনামে ঢাকাসহ নিজ জেলা কুমিল্লার হোমনায় চোখ ধাঁধানো মার্কেটসহ আইয়ুব খানের বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও কয়েক কোটি টাকা মূল্যে ক্রয়কৃত একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা গার্ডেন সিটিতে ফাঁকা ২টি প্লটের মধ্যে একটি প্লট ক্রয় করার চেষ্টা করছেন আইয়ুব খান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক সকালের সময়কে বলেন, আইয়ুব খান ৬ষ্ঠ গ্রেডের একজন কর্মকর্তা। ৬০-৬৫ হাজার টাকা বেতনভুক্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা পরিবারের আনুষঙ্গিক ব্যয় মিটিয়ে কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করা অসম্ভব। দৈনিক সকালের সময়ে ইতিপূর্বে প্রকাশিত সংবাদে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ সত্য বলে স্বীকার করেছেন অনেকেই।
ব্যাপারে উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খান দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি কে বলেন, ঢাকা গার্ডেন সিটিতে তার নিজ নামে ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাকি দুইটি ফ্ল্যাটের কথা তিনি স্বীকার করেননি। তিনি প্রয়োজনে নরসিংদী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুল হাসান তাপস এবং তার ভাগ্নে সোহেল রানার সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ফ্ল্যাট ২টি ক্রয় করতে তার ১ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে জিপিএফ (সাধারণ ভবিষ্য তহবিল) থেকে ৩১ লাখ টাকা এবং ব্যাংক থেকে ৩১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ঢাকা গার্ডেন সিটিতে অন্তত ১৫টি ফ্ল্যাট তিনি দেখাশোনা করেন। যেগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন জেলায় কর্মরত কর্মকর্তাদের।
ফ্ল্যাটের মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য নরসিংদী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুল হাসান তাপসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আইয়ুব খানের নিকট জিজ্ঞাসা করার অনুরোধ করেন। জানা গেছে, মাসুদুল হাসান তাপস ফ্ল্যাটটি প্রথমে কিনতে চাইলেও মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তার কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেন আইয়ুব খান।
এদিকে জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির অবৈধ পরিচালনা পর্ষদকে বৈধতা দিতে আইয়ুব খান ও ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রকনুল হকের যোগসাজশে অভিযোগের তদন্ত ফাইল আটকে রেখে ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে আবেদীত (সূত্র স্মারক: বিএনএসবি/২০২২/৬০, তারিখ: ১৯/০২/২০২২) নতুন কমিটি অনুমোদনের জন্য দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রকনুল হক এ তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি কে তিনি বলেন, দীর্ঘ দুই বছর পর এই ধরনের কমিটি গঠন করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ তদন্তে প্রমাণিত হলেও তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশ অনুযায়ী সুশাসন ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রশাসক নিয়োগ না করে দুই বছর আগের পুরাতন আবেদনের প্রেক্ষিতে অবৈধ পরিচালনা পর্ষদের অবৈধ কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমিটি গঠনের বিষয়ে ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রকনুল হকের মতামত জানতে দৈনিক আমাদের মাতৃভূমির পক্ষ থেকে তার মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে তার কাছে জানতে চাইলেও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির অবৈধ পরিচালনা পর্ষদকে সহযোগিতা করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খান। তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও মতামত দিতে বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি করতে থাকেন আইয়ুব খান। পরবর্তীতে তিনি এই মর্মে মতামত দেন যে, ডিজি স্যারের সাথে আলাপ হয়েছে। ডিডি ঢাকা বিষয়টির উপর তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রাপ্ত তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডিডি ঢাকা-কে বলা হয়েছে। এখানে একইসঙ্গে দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন সাংঘর্ষিক বলে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মতামত দিয়েছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তর হলো ফিল্ড পর্যায়ের সকল অফিসের নিয়ন্ত্রণকারী অফিস। নিয়ন্ত্রণকারী অফিস কর্তৃক নিয়োগকৃত তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে জেলা পর্যায়ের অফিস থেকে নতুন তদন্ত কমিটি গঠন এটাই প্রমাণ করে যে, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি’ সমাজসেবা অধিদপ্তরের সদর দপ্তর থেকে নিবন্ধিত হয়। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ঢ
কালের আবর্তে দখলদারদের দৌড়াত্ম্যর অবসান হবে কিনা এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খান এবং ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রকনুল হকের বিষয়ে গোপন তদন্ত চলছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি’র পক্ষ থেকে উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খানের অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতায়, ঘুষবাণিজ্য এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত চলছে। যা পরবর্তীতে প্রকাশ করা হবে।
আইয়ুব খানের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদের বিষয়ে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।