ঢাকা ১১:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
মৃত্যুর দুই দিন পর জহুর আলীর মরদেহ হস্তান্তর করল বিএসএফ বোরহানউদ্দিনে‘তারুণ্যের ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত পবিপ্রবির রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য হলেন বিখ্যাত আইটি বিশেষজ্ঞ শরফুদ্দিন দক্ষিণ মুগদা থানা ৭১ নং ওয়ার্ড যুবদলের কর্মীসভা অনুষ্ঠিত নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সংস্কারের বৈধতা আমরা দিতে পারব না: ফখরুল জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে পদক্ষেপের কথা জানালেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের ৭ সদস্য গ্রেফতার কোনো দল-গোষ্ঠী-ব্যক্তিকে সহযোগিতা করতে মাঠে নামিনি: সিইসি আনিসুল হক আরেক মামলায় গ্রেফতার চান্দিনায় মারুতির পেছনে বাসের ধাক্কায় শিশুর মৃত্যু,অন্তঃসত্ত্বা মা সহ আহত ৩

আন্দোলনে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতে ছাড় দেওয়ার কথা উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ছাড়ের চাপ রয়েছে ব্যাংক খাতের ওপর।

এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের বৈদেশিক খাতের ঋণের সুদ হার হ্রাস, কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, ঋণ পরিশোধের অক্ষমতার কারণে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত না করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে রাজস্ব ও নীতি সহায়তায় ছাড়ের চাপ। সৃষ্ট অস্থিরতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি আরও বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রবাসীদের একটি অংশ ইতোমধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ব্যাপারে জনমত গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এরইমধ্যে রপ্তানি আয়ে বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে এর নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। ফলে বৈদেশিক খাতে চাপ বেড়ে ডলারের দাম আরও বেড়ে টাকার মান কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

১৪ জুলাই থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ১৬ ও ১৭ জুলাই ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকা, কারফিউ জারি ও সরকারি সাধারণ ছুটির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বেশি মাত্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।

বিশেষ করে আমদানি, রপ্তানি, ব্যাংকিং সেবা, ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ ছিল। শিল্পের চাকাও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ হিসাবে সাড়ে ৬ থেকে ৭ দিনে গড়ে ৭৭ হাজার থেকে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল হয়নি। ফলে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়ছে।

এ ক্ষতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কম সুদে ঋণ দিতে বিশেষ তহবিল গঠন, চলমান ঋণের সুদহার কমানো, কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ঋণকে খেলাপি না করা, অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদহার কমানো ও কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো।

রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে আনার সময় বাড়ানো এবং আমদানির বিপরীতে নেওয়া ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। এসব দাবি মেটাতে গেলে চাপ আসবে ব্যাংক খাতের ওপর। কারণ ২০১৫ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় নানাভাবে সুদ মওকুফ, খেলাপি ঋণ নবায়নে ছাড় ও ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ ও ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দার কারণে ছাড় দেওয়া শুরু হয়। যা গত বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিছু ছাড় এখনও চালু রয়েছে।

এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমেছে। সুদ বাবদ আয়ও কমেছে। এদিকে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সব মিলে ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আবারও ছাড় ব্যাংক খাতের ওপর আরও বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এমনিতেই দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলো অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংক খাতের ওপর আরও চাপ দিলে খাতটি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এখন ব্যাংকে আমানত প্রবাহ বাড়ানো ও খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত করে জাল-জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে। যারা জালিয়াতি করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যাংক খাতের বিষয়ে গ্রাহকদের আস্থার সঞ্চার করতে হবে।

সূত্র জানায়, সরকারের এনবিআরবহির্ভূত কর ও এনবিআরের কর দুই খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরের ডেমারেজ চার্জসহ অন্যান্য ফি কমানোর দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে সরকারের এনবিআরবহির্ভূত খাতের রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে রাজস্ব আয়ও কমে যেতে পারে। ফলে সরকারের নিজস্ব উৎস থেকে ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থের জোগান বাড়ানো কঠিন হবে।

বিকল্প থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস বা ছাপানো টাকায় তহবিলের জোগান দেওয়া। ছাপানো টাকার কারণে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে গেছে। যা এখন আর কমছে না। নতুন করে আবার টাকা ছাপানো হলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ আরও বাড়বে। একই সঙ্গে আইএমএফ থেকেও আপত্তি তোলা হতে পারে। এছাড়া সুদহার কমানো ও খেলাপি ঋণ ছাড় দেওয়ার বিষয়েও আইএমএফের আপত্তি রয়েছে। কারণ সংস্থাটির শর্ত হচ্ছে, ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় এখনও কিছু ছাড় চলমান। আইএমএফ এটি বন্ধ করে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে আন্তর্জাতিকমানের করতে বলেছে। ফলে এসব খাতে ছাড় দিতে গেলে আইএমএফের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

দেশের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অনেক উদ্যোক্তা ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণের সুদও কমানো এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করা হচ্ছে। যেসব রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে আসেনি। অথচ নির্ধারিত সময় অতিক্রম হয়ে গেছে। সেগুলো দেশে আনার সময় বাড়ানো এবং আমদানি ঋণের পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি করা হচ্ছে।

রপ্তানি আয় দেশে আসতে দেরি হওয়ায় ডলারের প্রবাহ কমছে। ফলে ডলার সংকট আরও প্রকট হবে। এতে ডলারের দাম বাড়তে পারে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে আগামীতে সুদ পরিশোধ বাবত খরচ আরও বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ক্ষতি মোকাবিলার সম্ভাব্য পথ নিয়ে তারা কাজ করছেন। মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে ক্ষতি মোকাবিলায় নীতি সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

আন্দোলনের ফলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি আমদানিও। বিদেশে কোনো সমস্যা না থাকলেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব) রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের অর্থ জমা হয়নি তেমন। বাংলাদেশে আন্দোলন চলাকালে ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৫ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

এর আগে ১ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ১৮ দিনে এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশে গ্রাহকের হিসাবে রেমিট্যান্স পাঠানো সমস্যা ছিল। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে রেমিট্যান্স জমা হতে কোনো সমস্যা ছিল না। ছাত্রদের ওপর সরকারের গুলি বর্ষণের কারণেই প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চলছে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে প্রবাসীরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠায়। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রচারণায় ‘কান’ না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

মার্চ থেকে রপ্তানি আয় কমছে। জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্স বাড়লেও জুলাইয়ে কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গিয়ে ডলার ও রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে।

এদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ডলারের বেশি দাম দিয়েও কেনার জন্য মৌখিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা করেও রেমিট্যান্স কিনছে। আগে কিনত সর্বোচ্চ ১২২ টাকা করে। ফলে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ৩ টাকা বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর ডলার বিক্রির দামও ওই হারে বাড়বে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ডলারের দর সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা কার্যকর হচ্ছে না।

আন্দোলনের কারণে ইতোমধ্যে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আইএমএফের শর্তের কার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। এসব মিলে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে।

 

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মৃত্যুর দুই দিন পর জহুর আলীর মরদেহ হস্তান্তর করল বিএসএফ

আন্দোলনে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে

আপডেট সময় ১১:৩৪:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতে ছাড় দেওয়ার কথা উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ছাড়ের চাপ রয়েছে ব্যাংক খাতের ওপর।

এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের বৈদেশিক খাতের ঋণের সুদ হার হ্রাস, কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, ঋণ পরিশোধের অক্ষমতার কারণে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত না করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে রাজস্ব ও নীতি সহায়তায় ছাড়ের চাপ। সৃষ্ট অস্থিরতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি আরও বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রবাসীদের একটি অংশ ইতোমধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ব্যাপারে জনমত গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এরইমধ্যে রপ্তানি আয়ে বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে এর নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। ফলে বৈদেশিক খাতে চাপ বেড়ে ডলারের দাম আরও বেড়ে টাকার মান কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

১৪ জুলাই থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ১৬ ও ১৭ জুলাই ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকা, কারফিউ জারি ও সরকারি সাধারণ ছুটির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বেশি মাত্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।

বিশেষ করে আমদানি, রপ্তানি, ব্যাংকিং সেবা, ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ ছিল। শিল্পের চাকাও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ হিসাবে সাড়ে ৬ থেকে ৭ দিনে গড়ে ৭৭ হাজার থেকে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল হয়নি। ফলে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়ছে।

এ ক্ষতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কম সুদে ঋণ দিতে বিশেষ তহবিল গঠন, চলমান ঋণের সুদহার কমানো, কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ঋণকে খেলাপি না করা, অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদহার কমানো ও কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো।

রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে আনার সময় বাড়ানো এবং আমদানির বিপরীতে নেওয়া ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। এসব দাবি মেটাতে গেলে চাপ আসবে ব্যাংক খাতের ওপর। কারণ ২০১৫ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় নানাভাবে সুদ মওকুফ, খেলাপি ঋণ নবায়নে ছাড় ও ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ ও ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দার কারণে ছাড় দেওয়া শুরু হয়। যা গত বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিছু ছাড় এখনও চালু রয়েছে।

এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমেছে। সুদ বাবদ আয়ও কমেছে। এদিকে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সব মিলে ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আবারও ছাড় ব্যাংক খাতের ওপর আরও বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এমনিতেই দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলো অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংক খাতের ওপর আরও চাপ দিলে খাতটি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এখন ব্যাংকে আমানত প্রবাহ বাড়ানো ও খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত করে জাল-জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে। যারা জালিয়াতি করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যাংক খাতের বিষয়ে গ্রাহকদের আস্থার সঞ্চার করতে হবে।

সূত্র জানায়, সরকারের এনবিআরবহির্ভূত কর ও এনবিআরের কর দুই খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরের ডেমারেজ চার্জসহ অন্যান্য ফি কমানোর দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে সরকারের এনবিআরবহির্ভূত খাতের রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে রাজস্ব আয়ও কমে যেতে পারে। ফলে সরকারের নিজস্ব উৎস থেকে ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থের জোগান বাড়ানো কঠিন হবে।

বিকল্প থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস বা ছাপানো টাকায় তহবিলের জোগান দেওয়া। ছাপানো টাকার কারণে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে গেছে। যা এখন আর কমছে না। নতুন করে আবার টাকা ছাপানো হলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ আরও বাড়বে। একই সঙ্গে আইএমএফ থেকেও আপত্তি তোলা হতে পারে। এছাড়া সুদহার কমানো ও খেলাপি ঋণ ছাড় দেওয়ার বিষয়েও আইএমএফের আপত্তি রয়েছে। কারণ সংস্থাটির শর্ত হচ্ছে, ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় এখনও কিছু ছাড় চলমান। আইএমএফ এটি বন্ধ করে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে আন্তর্জাতিকমানের করতে বলেছে। ফলে এসব খাতে ছাড় দিতে গেলে আইএমএফের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

দেশের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অনেক উদ্যোক্তা ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণের সুদও কমানো এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করা হচ্ছে। যেসব রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে আসেনি। অথচ নির্ধারিত সময় অতিক্রম হয়ে গেছে। সেগুলো দেশে আনার সময় বাড়ানো এবং আমদানি ঋণের পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি করা হচ্ছে।

রপ্তানি আয় দেশে আসতে দেরি হওয়ায় ডলারের প্রবাহ কমছে। ফলে ডলার সংকট আরও প্রকট হবে। এতে ডলারের দাম বাড়তে পারে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে আগামীতে সুদ পরিশোধ বাবত খরচ আরও বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ক্ষতি মোকাবিলার সম্ভাব্য পথ নিয়ে তারা কাজ করছেন। মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে ক্ষতি মোকাবিলায় নীতি সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

আন্দোলনের ফলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি আমদানিও। বিদেশে কোনো সমস্যা না থাকলেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব) রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের অর্থ জমা হয়নি তেমন। বাংলাদেশে আন্দোলন চলাকালে ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৫ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

এর আগে ১ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ১৮ দিনে এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশে গ্রাহকের হিসাবে রেমিট্যান্স পাঠানো সমস্যা ছিল। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে রেমিট্যান্স জমা হতে কোনো সমস্যা ছিল না। ছাত্রদের ওপর সরকারের গুলি বর্ষণের কারণেই প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চলছে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে প্রবাসীরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠায়। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রচারণায় ‘কান’ না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

মার্চ থেকে রপ্তানি আয় কমছে। জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্স বাড়লেও জুলাইয়ে কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গিয়ে ডলার ও রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে।

এদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ডলারের বেশি দাম দিয়েও কেনার জন্য মৌখিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা করেও রেমিট্যান্স কিনছে। আগে কিনত সর্বোচ্চ ১২২ টাকা করে। ফলে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ৩ টাকা বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর ডলার বিক্রির দামও ওই হারে বাড়বে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ডলারের দর সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা কার্যকর হচ্ছে না।

আন্দোলনের কারণে ইতোমধ্যে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আইএমএফের শর্তের কার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। এসব মিলে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে।