ঢাকা ০৮:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বিআরটিএর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লার স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়

দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) লোকমান হোসেন মোল্লা ও তার স্ত্রী আরিফা হোসেনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে বিভিন্ন সংস্থা। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বিআরটিএর মধ্যে শুধুই কি লোকমান হোসেন মোল্লা একাই এই সম্পত্তি অর্জন করেছেন? নাকি এখনো যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জন করছে।” বিশ্লেষকরা বলছেন, সবাই না হলেও সিংহভাগ বিআরটিএর কর্মকর্তাই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি করছে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করলেও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বিআরটিএর অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সারির রেভিনিউ আদায়কারী একটি সংস্থা। এই সংস্থা বা দপ্তরটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য রয়েছে। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়াসহ ঢাকা শহরে গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছেন। সংস্থাটি মূলত সেবা প্রদান করার নামে গ্রাহকদের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের অপারেশন উইং এর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা চাকরির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিআরটিএর সবচাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত একজন কর্মকর্তা হিসেবে বহুল প্রচলিত। বিগত সময়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা তদন্তপূর্বক এর স্বপক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এছাড়াও সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় তিনি তার কালো টাকার হিসাব দিয়েও অনুকম্পা চেয়েছেন।

বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের সূত্র বলছে, লোকমান হোসেন মোল্লা ১৯৯০ সালে বিআরটিএ তে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে তিনি অবসরে যাবেন। এই কর্মকর্তার বাড়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায়। তার পিতা ছিলেন টেলিফোন বোর্ডের একজন হিসাব সহকারী। লোকমান হোসেন মোল্লার দুই ছেলে, তারা দুজনেই বাংলাদেশের সবচাইতে ব্যয়বহুল সানি ডেল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে লেখাপড়া করেন।

লোকমান হোসেন মোল্লার দুর্নীতির আংশিক তথ্যঃ যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার নজরে এসছে রাজধানীর লালমাটিয়া মোস্তফা প্যালেস, হাউস নম্বর-১, রোড নম্বর-১, ব্লক- সি, বর্ণিত ঠিকানায় ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন লোকমান হোসেন মোল্লা। বর্তমানে এই ফ্ল্যাটের মূল্য ১কোটি ৮০ লক্ষ টাকা প্রায়।

স্ত্রী আরিফা হোসেনের অবৈধ সম্পদঃ

১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর রেজিষ্ট্রেশন করা ৭৬৭০ নং দলিল মূলে রাজধানীর উত্তরায় ১২ কোটি টাকা (বর্তমান মূল্য) দামের ১২ কাটা জমি রয়েছে আরিফা হোসেনের।

১৯৯৫ সালের ০৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরে একটি প্লট নিয়েছেন, ডুইপ সপ প্লট নম্বর এস/১৮, রোড-১১, ব্লক- এইচ, সেকশন-২, মিরপুর- ঢাকা। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২ কোটি টাকা।

১৯৯৬ সালের ১১ নভেম্বর ডুইপ আবাসিকে ২ কাঠার আরো একটি প্লট কেনেন আরিফা হোসেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে ছয় তলা বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করেন। প্লট নম্বর ৭, লেন নম্বর-৮, ব্লক-বি সেকশন ২ মিরপুর। রেজিষ্ট্রেশনকৃত দলিলে টাকা উল্লেখ আছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৭১৪ টাকা। অথচ এই সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকা।

২০০৪ সালের ০৯ জুন আরিফা হোসেনের নামে সাভারের দিয়াখালি মোজায় ৩.৪ কাঠার প্লট ক্রয় করেছেন। যার দলিল নম্বর ১১০১১ রেজিষ্ট্রেশনের তারিখ ৯/৬/২০০৪। যার বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি টাকা।

২০০৮ সালের ০৫ মার্চ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের একটি প্রাইভেট কার ক্রয় করেন। যার রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ঢাকা মেট্রো গ-১১-৫৬৪৬ তবে গাড়িটি অনুসন্ধান চলাকালিন সময়ে তিন মাস আগে সৈয়দ ইসমত তোহা নামে পরিবর্তন করা হয়েছে। । বর্তমানে তার পরিবারের নামে বেনামে একাধিক গাড়ি রয়েছে।

এছাড়াও ঢাকার বেরাঈদে তার স্ত্রীর নামে ৪৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। বর্তমানে এটি পূর্বাচলের মধ্যে পড়েছে।

উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ৮ নম্বর রোডে ৩ কাঠার একটি প্লট ক্রয় করেছেন, বর্তমানে এর বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকার উপরে।

২০১২ সালে আরিফা হোসেন নিজ নামে দুটি ব্যাংকে (সোনালী ও জনতা ব্যাংক) থেকে ৪২ লক্ষ ২৫ টাকার দুটি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।

২০০৮ সালে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করেন, বিআরটিএ তে কর্মরত শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার তালিকায় তৎকালীন উপ-পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা ছিলেন ২ নম্বর।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী টাস্ক ফোর্সের তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা লোকমান হোসেন মোল্লা সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে নিজের দুর্নীতির আংশিক হিসাব জমা দিয়ে অনুকম্পা লাভ করেছেন। তবে সে সময় তিনি তার পুরো হিসাব জমা দেননি বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের ফরম নম্বর ২০২, ফাইল নম্বর সজক/আইন/২০০৮/এনসিসি/২১২ এর মাধ্যমে লোকমান হোসেন মোল্লা ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফর্ম সংগ্রহ করে ২২ সেপ্টেম্বর জমা দিয়ে আর কোন দিন দুর্নীতি করবেনা মর্মে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

বিআরটিএ যা ব্যবস্থা নিয়েছিলঃ ২০১৮ সালের ২৭ জুন তারিখের এক প্রজ্ঞাপন ও ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত গেজেট সূত্রে জানা যায়, নং- ৩৫.০৩.০০০০.০০১.০৪.০৩৪.১২-২৪৬৬ স্বারকমূলে লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর ৩ (বি) ও ৩ (ডি) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে একটি বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। মামলা নং- ১৪-২০১২। এই মামলায লোকমান হোসেন মোল্লা জবাব প্রদানের জন্য ১ মাস সময় চেয়েছিলেন। এই সুযোগে এই বিভাগীয় মামলার উপরে একটি উকিল নোটিশ প্রেরণ করেন। এছাড়াও সাবেক সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. নুরুজ্জামান ও মো. শহিদুল আযম মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ২ টি রিট পিটিশন (নং-৪৪৭৭/২০১২ ও ৪৪৭৮/২০১২) দায়ের করেন। উভয় রিট পিটিশনে ‍ãgainst the petitioner and other 33 employees উল্লেখ থাকায় যে আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় আদালত সেই আদেশের কার্যক্রম ৩ মাসের জন্য স্থগিত করে দেন। পরবর্তীতে এই বিভাগীয় মামলার বিরুদ্ধে আরো একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। পিটিশন নং- ৪৮৬৪/২০১২ রিট মামলায় স্থগিতাদেশ থাকায় বিভাগীয় মামলার পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরবর্তীতে তিনটি রিট পিটিশন মামলা প্রত্যাহার করে বিভাগীয় মামলার অভিযোগের জবাব দাখিল করেন। পরে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ লোকমান হোসেন মোল্লার ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহন করা হয়। ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২০১৭ সালের ১২ জুন ১৯৫৭ নং স্বারকমূলে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালামকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা একই সালের ১৩ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তে লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৫ জুন ২৪০৯ নং স্বারকমূলে চাকরি হতে কেন বরখাস্ত করা হবে না মর্মে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় মোল্লাকে। তিনি ২৭ জুন দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দাখিল করেন । এরপর লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, ১ম ও ২য় কারণ দর্শানোর জবাব ও সংশ্লিষ্ট সকল কাগজাদি পর্যালোচনায় সম্পদ অর্জনে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহন না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ৪১২২ নং প্রজ্ঞাপনমূলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ বিধিমালার ৪(২)(ই) বিধি মোতাবেক লোকমান হোসেন মোল্লাকে দোষী সাব্যস্থ করা হয়।

১৯৭৯ সালের গণকর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা কি কার্যকর আছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বিষয়টি আমার এ মুহূর্তে জানা নেই। আপনি একটু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো আদেশ জারি করেছে কি না খবর নিন। পাঁচ বছর অন্তর সম্পদ হ্রাস বৃদ্ধি উলে­খ করে সম্পদবিবরণী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে এই নিয়মের মধ্যে আমি আমার সময়ে একবার সকলের কাছ থেকে হিসাব নিয়েছিলাম।

সাম্প্রতিক লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে সিএনএস কর্তৃক মিরপুর বিআরটিএ’তে স্থাপিত ভেহিকেল ইনস্পেকশন সেন্টার স্থাপন করতে কোন ধরনের টেন্ডার আহবান না করে কাজটি সিএনএসকে দিয়ে করানোর জন্য লোকমান হোসেন মোল্লা এবং পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং উইং সিতাংশু শেখর বিশ্বাস সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে সিএনএস এর নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা উপটৌকন হিসেবে গ্রহণ করেন বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছেন। পরিচালক অপারেশন লোকমান হোসেন মোল্লার বেশ কয়েকজন আত্মীয় সিএনএস এবং মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেড এ কর্মরত রয়েছেন। লোকমান হোসেন মোল্লা ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে পিআরএল এ যাবেন। বিআরটিএর চাকুরী শেষ হওয়ার পূর্বেই সিএনএস এ যোগদান করার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন এবং সেখানে তার বেতনও নির্ধারিত হয়েছে ৩০০০০০/ টাকা এমন তথ্যও গোয়েন্দা সংস্থা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সাংবাদিক শাহাদাত হোসেনের উপর হামলা ও হত্যার হুমকি নিয়ে চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি

বিআরটিএর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লার স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়

আপডেট সময় ১১:৫৭:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুলাই ২০২৪

দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) লোকমান হোসেন মোল্লা ও তার স্ত্রী আরিফা হোসেনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে বিভিন্ন সংস্থা। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বিআরটিএর মধ্যে শুধুই কি লোকমান হোসেন মোল্লা একাই এই সম্পত্তি অর্জন করেছেন? নাকি এখনো যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জন করছে।” বিশ্লেষকরা বলছেন, সবাই না হলেও সিংহভাগ বিআরটিএর কর্মকর্তাই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি করছে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করলেও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বিআরটিএর অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সারির রেভিনিউ আদায়কারী একটি সংস্থা। এই সংস্থা বা দপ্তরটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য রয়েছে। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়াসহ ঢাকা শহরে গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছেন। সংস্থাটি মূলত সেবা প্রদান করার নামে গ্রাহকদের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের অপারেশন উইং এর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা চাকরির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিআরটিএর সবচাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত একজন কর্মকর্তা হিসেবে বহুল প্রচলিত। বিগত সময়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা তদন্তপূর্বক এর স্বপক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এছাড়াও সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় তিনি তার কালো টাকার হিসাব দিয়েও অনুকম্পা চেয়েছেন।

বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের সূত্র বলছে, লোকমান হোসেন মোল্লা ১৯৯০ সালে বিআরটিএ তে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে তিনি অবসরে যাবেন। এই কর্মকর্তার বাড়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায়। তার পিতা ছিলেন টেলিফোন বোর্ডের একজন হিসাব সহকারী। লোকমান হোসেন মোল্লার দুই ছেলে, তারা দুজনেই বাংলাদেশের সবচাইতে ব্যয়বহুল সানি ডেল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে লেখাপড়া করেন।

লোকমান হোসেন মোল্লার দুর্নীতির আংশিক তথ্যঃ যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার নজরে এসছে রাজধানীর লালমাটিয়া মোস্তফা প্যালেস, হাউস নম্বর-১, রোড নম্বর-১, ব্লক- সি, বর্ণিত ঠিকানায় ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন লোকমান হোসেন মোল্লা। বর্তমানে এই ফ্ল্যাটের মূল্য ১কোটি ৮০ লক্ষ টাকা প্রায়।

স্ত্রী আরিফা হোসেনের অবৈধ সম্পদঃ

১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর রেজিষ্ট্রেশন করা ৭৬৭০ নং দলিল মূলে রাজধানীর উত্তরায় ১২ কোটি টাকা (বর্তমান মূল্য) দামের ১২ কাটা জমি রয়েছে আরিফা হোসেনের।

১৯৯৫ সালের ০৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরে একটি প্লট নিয়েছেন, ডুইপ সপ প্লট নম্বর এস/১৮, রোড-১১, ব্লক- এইচ, সেকশন-২, মিরপুর- ঢাকা। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২ কোটি টাকা।

১৯৯৬ সালের ১১ নভেম্বর ডুইপ আবাসিকে ২ কাঠার আরো একটি প্লট কেনেন আরিফা হোসেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে ছয় তলা বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করেন। প্লট নম্বর ৭, লেন নম্বর-৮, ব্লক-বি সেকশন ২ মিরপুর। রেজিষ্ট্রেশনকৃত দলিলে টাকা উল্লেখ আছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৭১৪ টাকা। অথচ এই সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকা।

২০০৪ সালের ০৯ জুন আরিফা হোসেনের নামে সাভারের দিয়াখালি মোজায় ৩.৪ কাঠার প্লট ক্রয় করেছেন। যার দলিল নম্বর ১১০১১ রেজিষ্ট্রেশনের তারিখ ৯/৬/২০০৪। যার বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি টাকা।

২০০৮ সালের ০৫ মার্চ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের একটি প্রাইভেট কার ক্রয় করেন। যার রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ঢাকা মেট্রো গ-১১-৫৬৪৬ তবে গাড়িটি অনুসন্ধান চলাকালিন সময়ে তিন মাস আগে সৈয়দ ইসমত তোহা নামে পরিবর্তন করা হয়েছে। । বর্তমানে তার পরিবারের নামে বেনামে একাধিক গাড়ি রয়েছে।

এছাড়াও ঢাকার বেরাঈদে তার স্ত্রীর নামে ৪৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। বর্তমানে এটি পূর্বাচলের মধ্যে পড়েছে।

উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ৮ নম্বর রোডে ৩ কাঠার একটি প্লট ক্রয় করেছেন, বর্তমানে এর বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকার উপরে।

২০১২ সালে আরিফা হোসেন নিজ নামে দুটি ব্যাংকে (সোনালী ও জনতা ব্যাংক) থেকে ৪২ লক্ষ ২৫ টাকার দুটি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।

২০০৮ সালে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করেন, বিআরটিএ তে কর্মরত শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার তালিকায় তৎকালীন উপ-পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা ছিলেন ২ নম্বর।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী টাস্ক ফোর্সের তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা লোকমান হোসেন মোল্লা সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে নিজের দুর্নীতির আংশিক হিসাব জমা দিয়ে অনুকম্পা লাভ করেছেন। তবে সে সময় তিনি তার পুরো হিসাব জমা দেননি বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের ফরম নম্বর ২০২, ফাইল নম্বর সজক/আইন/২০০৮/এনসিসি/২১২ এর মাধ্যমে লোকমান হোসেন মোল্লা ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফর্ম সংগ্রহ করে ২২ সেপ্টেম্বর জমা দিয়ে আর কোন দিন দুর্নীতি করবেনা মর্মে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

বিআরটিএ যা ব্যবস্থা নিয়েছিলঃ ২০১৮ সালের ২৭ জুন তারিখের এক প্রজ্ঞাপন ও ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত গেজেট সূত্রে জানা যায়, নং- ৩৫.০৩.০০০০.০০১.০৪.০৩৪.১২-২৪৬৬ স্বারকমূলে লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর ৩ (বি) ও ৩ (ডি) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে একটি বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। মামলা নং- ১৪-২০১২। এই মামলায লোকমান হোসেন মোল্লা জবাব প্রদানের জন্য ১ মাস সময় চেয়েছিলেন। এই সুযোগে এই বিভাগীয় মামলার উপরে একটি উকিল নোটিশ প্রেরণ করেন। এছাড়াও সাবেক সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. নুরুজ্জামান ও মো. শহিদুল আযম মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ২ টি রিট পিটিশন (নং-৪৪৭৭/২০১২ ও ৪৪৭৮/২০১২) দায়ের করেন। উভয় রিট পিটিশনে ‍ãgainst the petitioner and other 33 employees উল্লেখ থাকায় যে আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় আদালত সেই আদেশের কার্যক্রম ৩ মাসের জন্য স্থগিত করে দেন। পরবর্তীতে এই বিভাগীয় মামলার বিরুদ্ধে আরো একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। পিটিশন নং- ৪৮৬৪/২০১২ রিট মামলায় স্থগিতাদেশ থাকায় বিভাগীয় মামলার পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরবর্তীতে তিনটি রিট পিটিশন মামলা প্রত্যাহার করে বিভাগীয় মামলার অভিযোগের জবাব দাখিল করেন। পরে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ লোকমান হোসেন মোল্লার ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহন করা হয়। ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২০১৭ সালের ১২ জুন ১৯৫৭ নং স্বারকমূলে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালামকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা একই সালের ১৩ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তে লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৫ জুন ২৪০৯ নং স্বারকমূলে চাকরি হতে কেন বরখাস্ত করা হবে না মর্মে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় মোল্লাকে। তিনি ২৭ জুন দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দাখিল করেন । এরপর লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, ১ম ও ২য় কারণ দর্শানোর জবাব ও সংশ্লিষ্ট সকল কাগজাদি পর্যালোচনায় সম্পদ অর্জনে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহন না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ৪১২২ নং প্রজ্ঞাপনমূলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ বিধিমালার ৪(২)(ই) বিধি মোতাবেক লোকমান হোসেন মোল্লাকে দোষী সাব্যস্থ করা হয়।

১৯৭৯ সালের গণকর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা কি কার্যকর আছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বিষয়টি আমার এ মুহূর্তে জানা নেই। আপনি একটু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো আদেশ জারি করেছে কি না খবর নিন। পাঁচ বছর অন্তর সম্পদ হ্রাস বৃদ্ধি উলে­খ করে সম্পদবিবরণী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে এই নিয়মের মধ্যে আমি আমার সময়ে একবার সকলের কাছ থেকে হিসাব নিয়েছিলাম।

সাম্প্রতিক লোকমান হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে সিএনএস কর্তৃক মিরপুর বিআরটিএ’তে স্থাপিত ভেহিকেল ইনস্পেকশন সেন্টার স্থাপন করতে কোন ধরনের টেন্ডার আহবান না করে কাজটি সিএনএসকে দিয়ে করানোর জন্য লোকমান হোসেন মোল্লা এবং পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং উইং সিতাংশু শেখর বিশ্বাস সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে সিএনএস এর নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা উপটৌকন হিসেবে গ্রহণ করেন বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছেন। পরিচালক অপারেশন লোকমান হোসেন মোল্লার বেশ কয়েকজন আত্মীয় সিএনএস এবং মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেড এ কর্মরত রয়েছেন। লোকমান হোসেন মোল্লা ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে পিআরএল এ যাবেন। বিআরটিএর চাকুরী শেষ হওয়ার পূর্বেই সিএনএস এ যোগদান করার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন এবং সেখানে তার বেতনও নির্ধারিত হয়েছে ৩০০০০০/ টাকা এমন তথ্যও গোয়েন্দা সংস্থা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।