ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে অন্তর্জাতিক বড় কোনো চক্রের হাত থাকতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তদন্তসংশ্লিষ্টরা এমন ধারণা করছেন।
তাদের মতে এই হত্যা নিছক রাজনৈতিক কারণে নয়, এর পেছনে রাজনীতির পাশাপাশি আরও বড় কোনো বিষয় আছে। যার সন্ধান করছেন এ ঘটনা তদন্তের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তদন্তে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে-নিহত এমপির পক্ষে ও বিপক্ষে যারা আছেন তারা বেশিরভাগই অন্ধকার জগতের লোক। চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এদের সঙ্গে দেশি ও বিদেশি অপরাধ চক্রের যোগাযোগ আছে।
অনেক সময় এরা একে অপরের হয়ে কাজ করে। আবার স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলে আন্তর্জাতিক চক্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এ ধরনের ঘটনা এক্ষেত্রেও ঘটেছে কি না তা খুঁজে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
অপরদিকে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড শাহীনের বিষয়ে জড়িতদের ভাষ্য-সে ছিল ‘রানি মৌমাছি’। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ করতে গত কয়েক বছরে সে যেদিকে গেছে তার পেছনে গেছে এক শ্রেণির অসাধু আমলা, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্তাব্যক্তিরা।
কারণ মদ, নারী এবং টাকার অভাব ছিল না তার। এই তিনটিকে কাজে লাগিয়ে সে আদায় করে নিয়েছে নিজের স্বার্থ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানতে চাইলে রোববার বিকালে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, হত্যকাণ্ডের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত না। একাধিক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হলেও, কেবল স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে এই চাঞ্চল্যকর হত্যকাণ্ড ঘটছে তা বলা যাচ্ছে না।
অপরদিকে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূইয়াসহ অন্যরা যে তথ্য দিয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক শাহীনকেই মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। আর শাহীনের বিষয়ে যেসব তথ্য এসেছে তা নিশ্চয় ভালো কিছু না।
তাই হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে রাজনীতির পাশাপাশি অন্তর্জাতিক চক্রের সংশ্লিষ্টতাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমপি চোরাচালানের কোনো কাজে ভারতে গিয়েছিলেন বলে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমরা এখনো পাইনি। তবে কোনো চক্র তাকে ফাঁদে ফেলে হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন কি না তাও তদন্তসংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় আছে।
সব বিষয়কে সামনে রেখেই আমাদের তদন্ত চলছে। কারণ হত্যার কারণের বিষয়ে এখনো কোনো কিছু আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, শাহীন হলেন রয়েল চিটার ডিপার্টমেন্টের (আরসিডি) লোক। অন্ধকার জগতের মাধ্যমেই সে অঢেল টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে। বড় কোনো ডিলিংসকে কেন্দ্র করেই হয়তো এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে শাহীন। আর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তার রাজনৈতিক শেল্টার প্রয়োজন ছিল।
এ কারণেই হয়তো বিষয়টি নিয়ে আনারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। আর নিজেদের স্বার্থেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতারা শাহীনকে শেল্টার দেওয়ার পাশাপাশি বিষয়টিকে ধামাচাপার চেষ্টা চালান। পাশাপাশি যুক্ত হন অর্থ লেনদেনে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহীনের অন্ধকার জগতের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা অল্প সময়েই গাড়ি-বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। কয়েক বছর আগেও যে লোক ভ্যান চালিয়েছে, শাহীনের দলে ভেড়ার পর সে দোতলা বাড়ি বানিয়েছে। দখলদারিত্ব এবং ভূমিদস্যুতায় জড়িত ছিল শাহীনের লোকজন।
এতে আরও বলা হয়, এমপি আনারের উত্থানও সেভাবে হয়নি। মাফিয়া চক্রের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। ২০০১ সালে অস্ত্র তাক করা অবস্থায় তার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের পরই অনার লাইমলাইটে আসে। তার বড় ভাই আবেদ আলী বহুবার গ্রেফতার হয়েছে। তার ভাগনে কালাম চেয়ারম্যান কিছুদিন আগেও র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। কালাম চেয়ারম্যানরা আট ভাই। ওই আট ভাই একসঙ্গে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বারো বাজারের যেখানে মাদকের হাট বসে এবং যে পয়েন্ট দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে মাদক ছড়িয়ে পড়ে সেটির নিয়ন্ত্রক হলো কালাম চেয়ারম্যানের আপন ভাই।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু।
জবানবন্দিতে তিনি ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, এমপি আনারকে হত্যার হত্যার পর মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে তার একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে হত্যা চুক্তির টাকার একটি অংশ সাইদুল করিম মিন্টুর কাছ থেকে নিয়ে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। এ জন্য এমপি খুনের পর আমানুল্লাহর সঙ্গে তার (কামাল) একাধিকবার মোবাইলে কথা হয় এবং সাক্ষাৎ হয়।
বাবু জবানবন্দিতে বলেছেন, আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে ব্যবসাসংক্রান্ত দ্বন্দ্বের কারণে এই খুনের পরিকল্পনা হয়। শাহীন পরিকল্পনা করলেও স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সহযোগিতা চান।
আনার বারবার এমপি হওয়ায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু মনে মনে ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাই মিন্টু তাকে (বাবু) নিয়ে আক্তারুজ্জামান শাহীনের ডাকে সাড়া দেন। শাহীন এমপি আনোয়ারুলকে শেষ করে দিতে পারলে সেখানে মিন্টুর এমপি হওয়ার স্বপ্নপূরণ হবে বলে বিশ্বাস ছিল। বাবু আরও বলেন, আমানুল্লাহর কাছ থেকে এমপির লাশের ছবি পাওয়ার পর তিনি চলে যান সাইদুল করিম মিন্টুর কাছে। মিন্টু তার কাছ থেকে তিনটি মোবাইল ফোনে ছবি নেন।
এদিকে নিজ কার্যালয়ে এক সভা শেষে শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এমপি আনার খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকাজ স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত সঠিকভাবে এগিয়ে চলছে। তদন্তে কারও হস্তক্ষেপ বা কোনো চাপ নেই। স্বাধীনভাবে আমরা তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে হত্যা মামলা। বিষয়টি নিয়ে ভারত এবং বাংলাদেশ- দুই দেশেই তদন্ত চলছে।
কালীগঞ্জে এমপির হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন : এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি ও ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে তার অনুসারীরা।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শহরের ভূষণ স্কুল সড়কের দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিলটি বের হয়। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার একই স্থানে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান রাসেল, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন সোহেলহ অন্যরা।
এ সময় বক্তারা বলেন, আস্তে আস্তে থলের বিড়াল বের হতে শুরু করেছে। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এই হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মিন্টুর অনুসারী কালীগঞ্জের অনেক নেতা এই হত্যাকাণ্ডে অর্থের জোগান দিয়েছে। তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে কালীগঞ্জ মোটর মালিক সমিতি। শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শহরের মেইন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এ মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে।