অলৌকিক কিছু নাকি দেখা যায় না! যা কেবল অতিপ্রাকৃত, মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারপরও একটা মিরাকলের আশায় ছিল বাংলাদেশ। সকাল গড়াতেই অ্যাডিলেড ওভালে সুখবরটা এনে দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় দলকে হারিয়ে যে অঘটনের জন্ম দিয়েছে তাতে লাভবান হতে পারত বাংলাদেশ দল। এরপর সমীকরণটা এমন দাঁড়ায়- পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতলেই প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষ চারে বাংলাদেশ। যদি-কিন্তুর সব হিসাব এক বিন্দুতে-শুধু জয়! ঠিক তখন নিজের হাতেই সেই সম্ভাবনাকে গলা টিপে মারলেন সাকিব আল হাসানরা!
দারুণ শুরুর পর ব্যাট হাতে ফ্লপ। এরপর বোলারদের সেই স্বল্প পুঁজি নিয়ে লড়াইটার শুরুতেই ক্যাচ ড্রপ! ব্যস, এভাবেই শেষ বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। টাইগারদের ৭ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পা রাখল পাকিস্তান। যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। আর ভারত লড়বে আরেক ম্যাচে ইংল্যান্ডের সঙ্গে!
অথচ সেই শেষ চারে থাকতে পারত বাংলাদেশের নাম। মঞ্চটা তো তৈরিই করে দিয়েছিল ডাচরা। রোববার সেই মঞ্চে আলো ছড়াতে পারলেন না টাইগাররা। শুরুতে অ্যাডিলেডের সবুজ গালিচায় বাংলাদেশ টস জিতে নেমে ২০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে তুলল ১২৭ রান। জবাবে পাকিস্তান ১৮তম ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে পা রাখে সেমিফাইনালে। বাজে ব্যাটিংই সব শেষ করে দিল। হেলায় সেমিতে উঠার সুযোগ হারানোর শঙ্কা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের।
ঠিক এ অবস্থায় এদিনও শুরুতে উইকেট পেতে পারতেন তাসকিন আহমেদ। ব্যাটিংয়ে হতাশ করে ফিল্ডিংয়েও নুরুল হাসান সোহান ক্যাচ ছাড়েন। তাসকিন আহমেদের বলে মোহাম্মদ রিজওয়ানের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ক্যাচ যায় সোহানের কাছে। কিন্তু সহজ ক্যাচটাও জমাতে পারেন নি। শূন্য রানে বাঁচলেন রিজওয়ান। তারপর আর পায় কে? প্রথম ১০ ওভারে দেখে-শুনে খেলে পাকিস্তান তুলে বিনা উইকেটে ৫৬ রান। রিজওয়ান ২৮ বলে ৩১, বাবর আজম ৩২ বলে ২৫!
মজবুত এটা ভিত্তি পেয়ে যায় তারা। তবে এরপরই বাবর আজমকে (৩৩ বলে ২৫) ফেরান নাসুম আহমেদ। তারপর প্রাণ পাওয়া রিজওয়ানকে ফেরান ইবাদত। অবশ্য তিনি করেন যান ৩২ বলে ৩২ রান। বড্ড দেরি হয়ে গেল, ততোক্ষণে ম্যাচটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারপর মোহাম্মদ নওয়াজকে দ্রুতই হন। ১১ বলে ৪ করে লিটন দাসের সরাসরি থ্রো-তে রানআউট! তারপর বাকি কাজটুকু সারেন শান মাসুদ ও মোহাম্মদ হারিস। হারিস অবশ্য শেষ দিকে এসে বিদায় নেন, এরপর ইফতিখার আহমেদও। তবে বাকি কাজটা অনায়াসেই সারে পাকিস্তান, চলে যায় সেমিফাইনালে পাকিস্তান।
এর আগে রোববার টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন সাকিব আল হাসান। আর জানিয়ে দেন দলে ৩ পরিবর্তন। ভারতের বিপক্ষে হেরে যাওয়া দলে তিনটি পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ। একাদশে ফিরেন সৌম্য সরকার। প্রথমবারের মতো এই বিশ্বকাপে জায়গা মেলে নাসুম আহমেদ ও ইবাদত হোসেনের। বাদ পড়েন ব্যাটসম্যান ইয়াসির আলি চৌধুরি এবং দুই পেসার হাসান মাহমুদ ও শরিফুল ইসলাম। আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে ঝড় তুলেছিলেন লিটন দাস।
সেই ম্যাচেই অবশ্য হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়েন। দু’দিন অবশ্য অনুশীলন করতে পারেন নি। তবে মাঠে নেমেই আগের ম্যাচের মতো মারদাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। দারুণ এক পুলে ছক্কা হাঁকান লিটন দাস। কিন্তু এরপরই শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে সর্বনাশ। ৬ বলে এক ছক্কায় ১০ রান করেন লিটন দাস। তবে অন্যপ্রান্তে নাজমুল হোসেন শান্ত লড়ে গেছেন। তার পথ ধরেই প্রথম ১০ ওভার শেষে বাংলাদেশ তুলে ১ উইকেটে ৭০ রান। তখন ১৫ বলে ১৮ সৌম্য সরকার। নাজমুল হোসেন শান্ত ৩৭ বলে ৪১ রানে। তারপর নাজমুল হোসেন শান্ত ও সৌম্য সরকার পথ দেখান দলকে।
দু’বার জীবন পেয়ে হাফসেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন শান্ত। মোহাম্মদ ওয়াসিম জুনিয়রের বলে কাভারে ক্যাচ দেন তিনি। তবে রক্ষা, সেই ক্যাচ নিতে পারেননি শাদাব খান। তখন তিনি ১১ রানে। সেই জীবন পেয়ে ৫৪ রান করেই থেমেছেন লিটন। খেলেছেন ৪৮ বল। সৌম্য সরকারও যেতে পারেননি বেশি দূর। দলে ফেরা এই ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যান থামেন ১৭ বলে ২০ রানে। শান্তর সঙ্গে গড়েন ৫২ রানের জুটি। বাংলাদেশও পড়ে যায় বিপদে।
তবে আম্পায়ারের একটা ভুল সিদ্ধান্তেই সর্বনাশ। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ভুল সিদ্ধান্তে আউট। আম্পায়ারের চমকে যাওয়া বাজে সিদ্ধান্ত গেল বাংলাদেশের বিপক্ষে। এগিয়ে এসে লেগ সাইডে খেলতে চেয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু এলবিডব্লিউ। যদিও পাকিস্তানের আবেদনে আম্পায়ার অনেক দেরিতে সিদ্ধান্ত জানান। তারপর রিভিউ নিতে ভুল করলেন না সাকিব। ব্যাটে বল লেগেছে এমনটাই আঁচ করা যাচ্ছিল।
রিপ্লেতে ব্যাটে বলের হালকা স্পর্শ হয়েছে এমনটা দেখা যায়। ব্যাট মাটির কাছে ছিল। এ অবস্থায় ব্যাট মাটিতে লেগেছে স্থীর থেকে তৃতীয় আম্পায়ার আউটের পক্ষেই রায় দেন। অথচ এটি আউট ছিল না। সাকিব হতাশ হয়ে ফেরেন প্রথম বলেই। দল পড়ে যায় ভয়াবহ চাপে! তারপর আর কিছুই হলো না। এমন একটা শুরুর পর শেষটাতে এসে শুধুই হতাশার গল্প। মোসাদ্দেক হোসেন ১১ বলে ৫।
নুরুল হাসান সোহান ৩ বল খেলে শুন্য, শাহীন শাহ আফ্রিদি ফেরান তাসকিনকে (১)। শেষটাতে ২০ বলে ২৪ রান করায় কিছুটা হলেও সম্মানজনক পুঁজি পায় বাংলাদেশ। এই ইনিংস খেলার পথে আফিফ তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে হাজার রান ক্লাবে পা রাখলেন! শাহিন শাহ আফ্রিদি ৪ ওভারে ২২ রান দিয়ে নেন ৪ উইকেট। তিনিই শেষ করে দেন টাইগারদের লাইনআপ! তবে নিশ্চিত করেই ১২৭ রানের সংগ্রহ হতাশাজনক।
যেখানে প্রথম ১০ ওভারে দল তুলেছিল ৭০ রান, সেখানে পরের ১০ ওভারে মাত্র ৫৭! ১২০ বলের ক্রিকেটে ৫৫ বল ডট। বিস্ময়কর! এই পুঁজি নিয়ে আর যাই হোক লড়াই করতে পারেন না বোলাররা। তারপরও দুই জয়ে এটিই হয়ে থাকল বাংলাদেশের সেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ! দুঃসময়ে থাকা বাংলাদেশ দল জিততে-লড়তে দেখাল তাসমান পাড়ে! হয়তো এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পেল বাংলাদেশ।