রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়ি কৃষির বাতিঘর। এখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মাধ্যমে সারাদেশে ২৫ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মকাণ্ড চলে। আর জেলায় অবস্থিত উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসগুলোর মাধ্যমে দেশের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কৃষকদের সেবা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিই কৃষি। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে এই কৃষি থেকে। ফলে চাষাবাদ পদ্ধতিকে আরও আধুনিকায়ন এবং উৎপাদনশীল করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচী গ্রহণ করে। কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, উচ্চ ফলনশীল জাত, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কৃষি খাত। আর এই কৃষির মূল কারিগর আমাদের দেশের কৃষক। তবে এসব উপজেলা অফিস থেকে কতটা সেবা পাচ্ছে প্রকৃত কৃষকরা, এমন প্রশ্ন সবার।
কৃষি খাতে নানা ভর্তুকি, প্রণোদনা, বরাদ্দ ও প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তবে সেই টাকার সুফল প্রান্তিক চাষিরা পাচ্ছেন কিনা, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
গাজীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগ, তদারকি ও জবাবদিহিতা না থাকায় অনেক সময় প্রকৃত কৃষকরা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পদে পদে হয়রানির মুখেও পড়ছেন তারা। অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক, রাজনৈতিক নেতা কিংবা বড় উদ্যোক্তা। কখনো কখনো প্রণোদনার টাকা বা সামগ্রী যথাযথ বণ্টন না করে নয়ছয়েরও অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মাঠ পর্যায়ের একটি চক্রের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে আছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি উপকরণের বাড়তি দর ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গেও লড়ছেন চাষি। জ্বালানি তেল ও সারের দাম বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে চরম সংকটে কৃষি খাত।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গাজীপুরসহ অনেক এলাকায় এবার আগের বছরের চেয়ে বৃষ্টি কমেছে ৫৩ শতাংশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরনেও রয়েছে অঞ্চলভিত্তিক এমন ভিন্নতা। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনায় না নেওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যও দেখা দেয়। এ প্রেক্ষাপটে চাষিদের সার্বিক সুবিধা দিতে অঞ্চলভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের কথা বলছেন সচেতন নাগরিকরা। তাদের মতে, কৃষিকে এগিয়ে নিতে ভর্তুকি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অনিয়ম দূর করতে জোরদার করতে হবে তদারকি।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গাজীপুর জেলার অনেক উপজেলার ইউনিয়নের ওয়ার্ডগুলোতে নিয়মিত যান না উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা। অনেকেই চিনেন না তাদের। বরাদ্দ বা প্রনোদনা আসলে তা নিয়ে নেন তাদের পছন্দের ব্যক্তি, বড় উদোক্তা বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। কৃষকের বরাদ্দের সার, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ নানা উপকরণ এনে চলে ভাগ-বাটোয়ারা।
টিআইবির জরিপেও উঠে এসেছিলো কৃষি খাতে অনিয়মের চিত্র। ১৫ হাজার ৪৫৪টি খানার (পরিবার) মাঝে করা ওই জরিপে বলা হয়, সার্বিকভাবে কৃষিতে সেবা নেওয়া খানাগুলোর মধ্যে ২৪.৪ শতাংশ কোনো না কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৪.৯ শতাংশ খানাকে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে। গড়ে ঘুষ গুনতে হয়েছে ২৬৬ টাকা। এছাড়া ৯.৫ শতাংশ তথ্য দিতে অসহযোগিতা, ৭.৬ শতাংশ স্বজনপ্রীতি, ৬ শতাংশ ব্লক সুপারভাইজার বা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ সময়মতো পাননি। জেলা কিংবা উপজেলা কৃষি অফিসে দুর্নীতির শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৩১.৯ শতাংশ। ঘুষ দেওয়া খানার হার ডিলারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ১২.৮ শতাংশ।
গাজীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার সচেতন নাগরিকরা বলছেন, উপজেলা কৃষি অফিসগুলো যেনও স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিকপ্রীতি এসব মেনে চলে। তারা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ ও প্রনোদনা প্রদান করে কিন্তু সরেজমিনে কখনো বড় বড় কর্মকর্তারা মাঠে আসেন না। তাদের নজরদারির অভাবেই প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গাজীপুর জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কথা হলে তিনি বলেন, কৃষকদের কখনোই অবহেলা বা বঞ্চনার মধ্যে থাকতে দিচ্ছে না সরকার। তাদের সবসময়ই উৎপাদনশীল ও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান করতে সব ধরনের আর্থিক ও নীতিসহায়তা জোরদার করা হচ্ছে। কৃষকের জন্য যা যা করা দরকার সব করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভর্তুকিসহ নানারকম প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে। তবে সেবা দিতে গাফিলতি কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।