বগুড়ার সোনাতলায় ভূমিহীনদের চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে ২০০৮ সালে ১৬৬ বিঘা খাস জমি বন্দোবস্ত দেয় সরকার। কিন্তু সেই জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে খাচ্ছিলেন। পরে জমি উদ্ধারে ভূমিহীনরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটনের শরণাপন্ন হন। জমি উদ্ধার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলিলের ফটোকপিসহ কাগজপত্র জমা নেন তিনি। এর পর বছরের পর বছর ঘুরলেও জমি বুঝে পাননি ২৮ ভূমিহীন। উল্টো জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে জমির মালিকানা দাবি করেন লিটন। ওই জমিতে সাতটি পুকুর করে গড়ে তোলেন মৎস্য খামার।
শুধু এই জমি দখলই নয়, লিটনের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। নিয়োগ বাণিজ্য ও দখলবাজিতে এলাকায় পরিচিত মুখ তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁকে চাহিদা মতো টাকা দিলেই মিলত স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় চাকরি। তাঁর দখলবাজির প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ। তাঁর লাঠিয়াল বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকত স্থানীয়রা। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই লিটন আত্মগোপনে। দেখা মিলছে না তাঁর বাহিনীরও।
লিটন বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের প্রয়াত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের শ্যালক। মান্নানের মৃত্যুর পর ২০২০ সালের উপনির্বাচনে আসনটিতে এমপি হন লিটনের বোন সাহাদারা মান্নান। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি হন তিনি। ভগ্নিপতি ও বোনের সুবাদে লিটন সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ার দখল করেন। এর পর শুরু করেন নিয়োগ বাণিজ্য আর দখলবাজি।
সোনাতলা উপজেলার ছোট বালুয়া গ্রামের নাজমুল হক জানান, রশিদপুর মৌজায় তাঁকে সরকার থেকে ৮০ শতক ধানি জমি দলিল মূলে বন্দোবস্ত দেয়। কিন্তু দলিলই শুধু আছে, বাস্তবে জমি দখল করে পুকুর বানিয়েছেন লিটন। জমির দখল পেতে লিটনের কাছে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছি। আমরা বুঝতে পারিনি, তিনি আমাদের মতো গরিবদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করবেন। এ নিয়ে আদালত ও থানায় অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। এখন লিটন না থাকলেও ধানি জমিগুলো শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তা বুঝে পাওয়া জটিল হয়ে গেছে।
পুকুরের পাশের পাতিলাকুড়ার বাসিন্দা মনির হোসেনের ৯ বিঘা জমি দখল করে পুকুরের পরিধি বাড়িয়েছেন লিটন। মনির হোসেন বলেন, খাস জমির পাশে আমাদের বাপদাদার ৯ বিঘা জমি লিটন দখল করেছেন। জমিতে গেলে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় তার লাঠিয়াল বাহিনী। ওই পুকুর দেখভাল করেন লিটনের আত্মীয় আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, আমি পুকুর দেখাশোনা করতাম, এখন আর সেখানে যাই না।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খাদিজা খাতুন বলেন, ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে সরকার। কিন্তু কে দখল করে আছে, তা জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও অনিয়ম: সোনাতলা উপজেলায় বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা ১৩৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানে গত ১০ বছরে দেড় হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে লিটন কমপক্ষে শতকোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের ডিসেম্বরে উপজেলার কর্পূর উচ্চ বিদ্যালয়ে সাতজনকে নিয়োগের সময় লিটনের অনিয়মে বাধা দেন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রেজাউল করিম।
রেজাউল জানান, পরে তাঁকে সরিয়ে লিটন নিজেই সভাপতি হয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাজমিনা আক্তারের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের থেকে ৮৫ লাখ টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেন। এ নিয়ে গত মার্চে তিনি আদালতে মামলা করলেও লিটন ক্ষমতা দেখিয়ে তা ধামাচাপা দেন। মামলাটি আবার চালু করবেন বলে জানান রেজাউল।
উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিবির দুই কোটি ও হাটবাজার ইজারার প্রায় তিন কোটিসহ পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করায় তাঁর বিরুদ্ধে দুদক ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে অভিযোগ করলে বিষয়টির তদন্ত হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপপরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের ২০ জুন তদন্ত করতে গেলে লিটন তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হননি। পরে আমি অন্যত্র বদলি হওয়ায় সেটা নিয়ে আর কাজ করতে পারিনি।