বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে অনেকেই দলীয় পরিচয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এতে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। আবার অনেকেই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের করা দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণেও কেউ কেউ পলাতক রয়েছেন।
একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতিপয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার বানাচ্ছে। তাদের ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্ব ও আক্রোশ থেকে শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে ছাত্ররা। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে শিক্ষকের স্ট্রোক করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকরা এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আইনের তোয়াক্কা না করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করায় শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ বিরাজ করছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবার ব্যতিক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের পদত্যাগের ঘটনা। নিকট অতীতেও সরকার পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন। কারণ, তিনি তো দলের আনুগত্যের জন্যই উক্ত পদে আসীন হন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা পেরিয়ে মাধ্যমিক ও কলেজে এর হাওয়া লেগেছে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া কোমলমতি ছাত্ররা হয়তো জানেন না ভিসির নিয়োগ-পদত্যাগ এবং স্কুল কলেজের নিয়োগ পদত্যাগ বিধিবিধান এক নয়।
অধিকাংশ ভিসির নিয়োগ থাকে চুক্তিভিত্তিক। বেগতিক দেখলে পদ ছেড়ে চলে গেলেও সমস্যা নেই। স্কুল-কলেজের প্রধানদের নিয়োগ স্থায়ী। চাপে পড়ে ইস্তফা দিলেও পরে আইনের আশ্রয় নেবেন। মাধ্যমিক ও কলেজের দলকানা কতিপয় প্রধান এমন সব কার্যকলাপ করে বসেছেন যার খেসারত গোটা শিক্ষক সমাজকে দিতে হচ্ছে।
বিগত এক যুগে শিক্ষকের পেশাদারিত্ব ও শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ছাত্রদের উশৃঙ্খল আচরণের জন্য শিক্ষকের অনৈতিক কার্যকলাপ ও শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। বিগত দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় প্রভাব এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো দলীয় শিক্ষকেরা রাতকে দিন বানিয়ে ফেলেছেন। তাদের সব অন্যায় অবিচার ছাত্র, অভিভাবক, বাকি শিক্ষকদের নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শিক্ষার্থী, অভিভাবকেরা এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।
এছাড়া দেশের সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রদের নৈতিক অবক্ষয়ে ভূমিকা রাখছে। সংক্ষুব্ধ ছাত্র, অভিভাবক যেভাবে শিক্ষককে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে টেনে-হিঁচড়ে নামাচ্ছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। দুর্নীতিবাজ, নৈতিক স্খলন শিক্ষকের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে নয়, সেটা হতে হবে অবশ্যই আইনসম্মত বিধি মোতাবেক।
এ নিয়ে গত ২১ আগস্ট সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তবর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্বরতদের জোর করে পদত্যাগ ও অপমান করা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে অসুবিধা হবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে।
শিক্ষকরা বলছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্ম একটি সফল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের অর্জিত এ সাফল্যকে ধরে রাখতে হলে সমন্বয়কদের আরো সজাগ থাকাতে হবে, যেন অতি উৎসাহী হয়ে কোনো অছাত্র তাদের অর্জনকে ম্লান করতে না পারে; এমন মত তাদের।
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন আ ন ম সামসুল আলম। বিগত সরকার পতনের পর নানাভাবে তাকে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করা হয়। নানা অপবাদ দিয়ে তার পদত্যাগের জন্য একদল শিক্ষক মাঠে নেমেছেন। কিন্তু এসব অপবাদ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে অন্য শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একধরনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়।
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যুগান্তরকে বলেন, স্কুলের কতিপয় শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের লিপ্ত। তারা বিভিন্নভাবে হয়রানির করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের কোনো অভিযোগ এখনো সত্য প্রমাণিত হয়নি। যদিও বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আসছে বলে জানান তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে একদল কিশোর ও যুবক গিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি করেন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কিছু বহিরাগত ছাত্র স্কুলের শিক্ষকদের জোর করে মিটিং করতে বাধ্য করেন। এ মিটিং থেকে অধ্যক্ষের পদত্যাগের পক্ষে শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বিষয়টি ঢাবির প্রক্টরকে জানানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল হালিম জানান, স্কুল-কলেজে পড়া কতিপয় ছেলে এসে অধ্যক্ষকে পদত্যাগের দাবি জানান। তাদের সঙ্গে আমাদের স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী যোগ দেন। তারা শিক্ষকদের মিটিং করতে বাধ্য করেন।
বুধবার শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে তিনি নিজ কার্যালয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, উনি স্ট্রোক করেছিলেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘটনাকে কেন্দ্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান নামে এক শিক্ষক ফেসবুকে লিখেছেন, স্কুল-কলেজে নিজ শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা লাঞ্ছনা করছে। আইনের তোয়াক্কা না করে পদত্যাগ করাচ্ছে। এর ফল ভোগ করতেই হবে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া শাস্তি বড় মর্মান্তিক বলে মন্তব্য করেছেন।
এছাড়া রাজধানী ঢাকায় গত দুই সপ্তাহে অন্তত ৪০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পদ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, আবার কাউকে চাপের মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।