ঢাকা ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
চিন্ময়ের গ্রেফতার ও সাইফুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত অপতথ্য ছড়িয়েছে বাংলাদেশকে ২২৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জার্মানি দুদকের মামলায় অব্যাহতি পেলেন জামায়াত সেক্রেটারি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে মেয়াদ উত্তীর্ণ কীটনাশক বীজ রাখার দায়ে তিন প্রতিষ্ঠানকে জরিমান গুজবে কান দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি না করার আহবান জাবিতে ছাত্রদলের দুগ্রুপে উত্তেজনা, বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধার পরকীয়ার জেরে স্বামী খুন, স্ত্রী প্রেমিকসহ ৩ জনের ফাঁসি নিটওয়্যার উদ্ভাবন ও সহযোগিতায় সিজিং ‘বাংলাদেশ নাইট’ ১১১ নারীকে ধর্ষণ–যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত ধনকুবের ফায়েদ ইসকন ও আ.লীগকে নিষিদ্ধের দাবি বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের

বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌: কূটনীতি ও আইনের সুশাসক

প্লেটীয় কিংবা এরিস্টটলীয় অভিজাতন্ত্রীয় Aristocracy গণতন্ত্রের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে অথবা আলবার্ট ভ্যান ডাইসির আইনের শাসনের যে সূত্র (১) বিনা বিচার শাস্তি না হওয়া এবং (২) আইনের চোখে সকলের সাম্যতা বাস্তবায়নে একজন  সুশাসকের কোন বিকল্প নেই।

প্রথম ইলিয়াস শাহ-র রাজবংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১) সংবেদনশীল দক্ষ সুশাসক এক বিশ্বায়নেও তার কৃতিত্ব অসামান্য নয়। সুলতান একদা জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বশত তীর শিকারকে আঘাত না করে এবং গরীব বৃদ্ধার ছেলেকে বিদ্ধ করে। তাৎক্ষনিক মৃত্যুতে ডলে পরে ছেলেটি । তার সময়ে আদালত বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন ছিল যে, বিধবা অনায়াসে রাজার বিরুদ্ধে মামলা করতে পেরেছিল।

যেখানে বৃটিশ আইনে এখনও শিক্ষা দেয়া হয়, ‘কিং ক্যান  ডু নো রং’ রাজা কোন অপরাধ করতে পারে না। বিচারপতি বা কাজী কতটা প্রভাবমুক্ত বা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলে সে রাজাকে এজলাসে কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারে। বিচার-প্রক্রিয়া আইন সংহতভাবে সম্পন্ন হয় এবং বিচারে সুলতানকে বড় অংকের জরিমানার শাস্তি দেয়া হয়।

পরিশেষে সুলতান কাজী সিরাজুদ্দিনকে বলেন, আপনি যদি আমার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আইনসম্মত বিচার থেকে বিরত থাকতেন তাহলে আমার তরবারি আপনাকে আঘাত করতে দ্বিধা করতো না। জবাবে কাজী বলেন, আপনি যদি আদালতের বিচার অমান্য করতেন আমার বেত্রাঘাত আপনাকে ক্ষমা করতো না। পৃথিবীর বিচারব্যবস্থা রাজার শাসনে এ এক বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত।

গিয়াসুদ্দিনের বুদ্ধিদীপ্ত উদার পররাষ্ট্রনীতিও এক অনন্যতম বহন করে। ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজা খাজা জাহানের সাথের বন্ধুত্ব ছিল বলার মতন। চীনের প্রতাপশালী সম্রাট ইয়ং লি (১৩৬২-১৬০৭) এর সাথে তার উপহার দেয়া আনা হতো। বিজ্ঞানে জ্ঞানে অগ্রসর চীনে তিনি ১৪০৫, ১৪০৮, ১৪০৯ সালে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন। মক্কা মদিনায়ও তার দূত যথারীতি প্রেরিত হতো। শুধু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনই নয়, তিনি মনীষী-জ্ঞানী-গুণীদের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; ছিলেন ভাল কবিও। ইউসোপ-জোলেখার রচয়িতা কবি শাহ্‌ মুহম্মদ সগীর, রামায়ণের বাংলা অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা সহ অনেক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বুজুর্গের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করতেন। মিষ্টিক বা মরমি সাহিত্যের  জগতে যাকে নিয়ে হই হই রই রই। রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ, নজরুল, ভাই গিরিশচন্দ্র আরো অনেকে যার সৃষ্টিকর্মে কবিতায় আত্মহারা ছিলেন ।

স্বয়ং শ্রীচৈতন্য ও চন্ডীদাস যার কাব্যরসে বিমোহিত ছিলেন। তিনি হলেন ইরানের হাফেজ শিরাজি (১৩২৫/২৬-১৩৮৯/৯০) । এ মহান সাধক কবির সাথে  সুলতানের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত নিগূঢ় অত্যন্ত প্রগাঢ়। হাফিজের একটি জনপ্রিয় গীতিকবিতায় বাংলার মহিমার উল্লেখ আছে। একই কবিতায় সুলতান গিয়াসুদ্দিনকে ও  তার দরবারকে ‘হৃদয় চাঁদ’ বলে অবহিত করা হয়েছে।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী  সুনারগাঁয়ে এ মহান ব্যক্তির মাজার যেন আজও সুশাসন, ন্যায়নীতি উদার বাংলার বর্ণাঢ্য সোনালী অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ জীবনের মহিমায় মুজাহিদ মসির কাব্যঃ সুশাসক গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ আত্মদন্ডে দন্ডিত যে জন সেইতো হয় স্বচ্ছ দিলের বাদশাহ্‌, সুলতান হয়েও কাঠগড়ায় মাথানত গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ । দেশ-বিদেশে দূত পাঠিয়েছেন সমুন্নত করতে রাজ্যযন্ত্রের গতি, ইয়ং লি ও খাজা জাহানের সাথে ছিল তার বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনীতি।

মনীষী-জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক তিনি দিয়েছেন তাদের উদ্দীপনা, আইনস্টাইন বলেন প্রতিভার নিরানব্বই ভাগই হল অনুপ্রেরণা। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ে আছে এই সুশাসকের মাজার, হাফিজ শিরাজি লিখেছিলেন হৃদয়চাঁদ গিয়াসুদ্দিনের দরবার ।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

চিন্ময়ের গ্রেফতার ও সাইফুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত অপতথ্য ছড়িয়েছে

বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌: কূটনীতি ও আইনের সুশাসক

আপডেট সময় ১১:৪১:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

প্লেটীয় কিংবা এরিস্টটলীয় অভিজাতন্ত্রীয় Aristocracy গণতন্ত্রের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে অথবা আলবার্ট ভ্যান ডাইসির আইনের শাসনের যে সূত্র (১) বিনা বিচার শাস্তি না হওয়া এবং (২) আইনের চোখে সকলের সাম্যতা বাস্তবায়নে একজন  সুশাসকের কোন বিকল্প নেই।

প্রথম ইলিয়াস শাহ-র রাজবংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১) সংবেদনশীল দক্ষ সুশাসক এক বিশ্বায়নেও তার কৃতিত্ব অসামান্য নয়। সুলতান একদা জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বশত তীর শিকারকে আঘাত না করে এবং গরীব বৃদ্ধার ছেলেকে বিদ্ধ করে। তাৎক্ষনিক মৃত্যুতে ডলে পরে ছেলেটি । তার সময়ে আদালত বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন ছিল যে, বিধবা অনায়াসে রাজার বিরুদ্ধে মামলা করতে পেরেছিল।

যেখানে বৃটিশ আইনে এখনও শিক্ষা দেয়া হয়, ‘কিং ক্যান  ডু নো রং’ রাজা কোন অপরাধ করতে পারে না। বিচারপতি বা কাজী কতটা প্রভাবমুক্ত বা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলে সে রাজাকে এজলাসে কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারে। বিচার-প্রক্রিয়া আইন সংহতভাবে সম্পন্ন হয় এবং বিচারে সুলতানকে বড় অংকের জরিমানার শাস্তি দেয়া হয়।

পরিশেষে সুলতান কাজী সিরাজুদ্দিনকে বলেন, আপনি যদি আমার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আইনসম্মত বিচার থেকে বিরত থাকতেন তাহলে আমার তরবারি আপনাকে আঘাত করতে দ্বিধা করতো না। জবাবে কাজী বলেন, আপনি যদি আদালতের বিচার অমান্য করতেন আমার বেত্রাঘাত আপনাকে ক্ষমা করতো না। পৃথিবীর বিচারব্যবস্থা রাজার শাসনে এ এক বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত।

গিয়াসুদ্দিনের বুদ্ধিদীপ্ত উদার পররাষ্ট্রনীতিও এক অনন্যতম বহন করে। ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজা খাজা জাহানের সাথের বন্ধুত্ব ছিল বলার মতন। চীনের প্রতাপশালী সম্রাট ইয়ং লি (১৩৬২-১৬০৭) এর সাথে তার উপহার দেয়া আনা হতো। বিজ্ঞানে জ্ঞানে অগ্রসর চীনে তিনি ১৪০৫, ১৪০৮, ১৪০৯ সালে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন। মক্কা মদিনায়ও তার দূত যথারীতি প্রেরিত হতো। শুধু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনই নয়, তিনি মনীষী-জ্ঞানী-গুণীদের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; ছিলেন ভাল কবিও। ইউসোপ-জোলেখার রচয়িতা কবি শাহ্‌ মুহম্মদ সগীর, রামায়ণের বাংলা অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা সহ অনেক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বুজুর্গের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করতেন। মিষ্টিক বা মরমি সাহিত্যের  জগতে যাকে নিয়ে হই হই রই রই। রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ, নজরুল, ভাই গিরিশচন্দ্র আরো অনেকে যার সৃষ্টিকর্মে কবিতায় আত্মহারা ছিলেন ।

স্বয়ং শ্রীচৈতন্য ও চন্ডীদাস যার কাব্যরসে বিমোহিত ছিলেন। তিনি হলেন ইরানের হাফেজ শিরাজি (১৩২৫/২৬-১৩৮৯/৯০) । এ মহান সাধক কবির সাথে  সুলতানের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত নিগূঢ় অত্যন্ত প্রগাঢ়। হাফিজের একটি জনপ্রিয় গীতিকবিতায় বাংলার মহিমার উল্লেখ আছে। একই কবিতায় সুলতান গিয়াসুদ্দিনকে ও  তার দরবারকে ‘হৃদয় চাঁদ’ বলে অবহিত করা হয়েছে।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী  সুনারগাঁয়ে এ মহান ব্যক্তির মাজার যেন আজও সুশাসন, ন্যায়নীতি উদার বাংলার বর্ণাঢ্য সোনালী অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ জীবনের মহিমায় মুজাহিদ মসির কাব্যঃ সুশাসক গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ আত্মদন্ডে দন্ডিত যে জন সেইতো হয় স্বচ্ছ দিলের বাদশাহ্‌, সুলতান হয়েও কাঠগড়ায় মাথানত গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌ । দেশ-বিদেশে দূত পাঠিয়েছেন সমুন্নত করতে রাজ্যযন্ত্রের গতি, ইয়ং লি ও খাজা জাহানের সাথে ছিল তার বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনীতি।

মনীষী-জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক তিনি দিয়েছেন তাদের উদ্দীপনা, আইনস্টাইন বলেন প্রতিভার নিরানব্বই ভাগই হল অনুপ্রেরণা। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ে আছে এই সুশাসকের মাজার, হাফিজ শিরাজি লিখেছিলেন হৃদয়চাঁদ গিয়াসুদ্দিনের দরবার ।