মানুষের জীবনের সঙ্গে বাত রোগ অনেকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গে ব্যথা বেদনার প্রকোপ দেশের ২৬ শতাংশ মানুষের। ৬৪৪ প্রকারের বাত ব্যথা মেডিসিন বিভাগের রিউমাটোলজির রোগ হিসেবে পরিচিত। এতসব রোগের মধ্যে বেশি প্রকোপের রোগগুলো হলো— অস্ট্রিও আর্থ্রাইটিস, অস্ট্রিপোরোসিস বা হাড়ক্ষয় রোগ, মাজাব্যথা বাত বা স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস বা লুপুস। এছাড়া সেপটিক আর্থ্রারাইটিস, রিয়্যাক্টিভ আর্থ্রারাইটিসেও ভুগছেন দেশের অনেক মানুষ।
শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কনভেনশন হলে বাত রোগীদের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান বাতরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম।
বাত রোগীদের নিয়ে রিসার্চের তথ্য-উপাত্তের কথা তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশের উপাত্ত অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ নারী-পুরুষ হাড়ক্ষয় রোগ, প্রায় ১৭ লাখ মানুষ রিউমাটয়েড আর্থ্রারাইটিস, প্রায় ৮০ লাখ মানুষ ওয়ে নি বা হাঁটুব্যথা বাতে এবং প্রায় ১৩ লাখ মানুষ মাজাব্যথা বা স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস রোগে ভুগছেন।
প্রফেসর নজরুল রিউমাটোলোজি ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পিএনআরএফআর) ট্রাস্ট সপ্তমবারের মতো এই রোগী সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাত রোগে ভোগা কয়েকশ রোগী ও তাদের স্বজনরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে রোগীরা তাদের বাত ব্যথার কষ্টের কথা তুলে ধরেন। এসময় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বাত রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়।
বাত রোগে আক্রান্তদের কষ্টের কথা তুলে ধরে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আক্রান্তের হার থেকে দেখা যায় বাতের রোগগুলো অনেক মানুষকে কষ্টে রাখে। রোগগুলোর যথাযথ চিকিৎসার অভাবে কর্মক্ষম মানুষ যেমন অক্ষম হন তেমনি পরিবারগুলোও দরিদ্র হতে থাকে। তাই সবার আগে জরুরি যথাসময়ে রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা। তবে বাস্তবতা হলো, আমরা নিজেরা সচেতন নই। পাশাপাশি রোগী ও তাদের স্বজনদের চিকিৎসার সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।
বাত রোগের সুচিকিৎসার জন্য আরও গোছানো ও অনেকগুলো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং বাতরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসক ডা. নজরুল ইসলাম।
এই রোগের প্রতিকারের পরামর্শ দিতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন, সুষম খাদ্যগ্রহণ, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেওয়া, নিয়মিত প্রয়োজনীয় ব্যায়াম করা, জীবনযাপনে চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা এবং নিয়ম করে ওষুধ সেবন করা সবার আগে জরুরি। কারণ বাতের রোগের চিকিৎসায় ব্যথানাশকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খেলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ডায়াবেটিকস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো বাতের রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাতের রোগগুলো চিকিৎসায় ভালো থাকে। তাই যতদিন যেমন করে ওষুধ খেতে হবে তা চালিয়ে যেতে হবে। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া আমাদের কারো কাম্য নয়।
সরকার যা করছে এর বাইরেও বাত রোগীদের জন্য বেসরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, তেমন একটি উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান প্রফেসর নজরুল রিউমাটোলোজি ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পিএনআরএফআর) ট্রাস্ট। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ট্রাস্ট বাত রোগীদের জীবনযাপন সহজ করা, চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে আসছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে দিনে দিনে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হচ্ছে। অনেক জটিল ও কঠিন রোগের বিশ্বমানের চিকিৎসা দিচ্ছেন আমাদের চিকিৎসকরা, যা সত্যি আমাদের সাহস যোগায়। আগামী দিনগুলোতে চিকিৎসকদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার গবেষণা করার জোর তাগিদ দিচ্ছেন এবং গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দও দিচ্ছেন। কারণ গবেষণা থেকেই জানা যায় আসল চিত্র। আজ যাদের জন্য এই আয়োজন সেই বাত রোগে আক্রান্তদেরও বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে গবেষণায়। তাতে মনে হচ্ছে, আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। যদিও সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য খাত অন্যতম।
তিনি বলেন, দেশে এখন মানুষ গ্রামে বসে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। নতুন নতুন অনেক চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক অর্জনও রয়েছে। এসবের নেপথ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নির্দেশনা।
ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক লিয়াকত আলি, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক সদস্য অধ্যাপক সুরাইয়া বেগম, সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন, সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ব্র্যাকের হেলথ এন্টারপ্রাইজের প্রধান ব্রি. জেনারেল (অব.) ডা. তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী প্রমুখ।