ঢাকা ০২:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সুন্দরবন সুরক্ষায় করণীয়

২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের অংশ।

বৃহত্তর খুলনা বিভাগের কয়েক লক্ষ মানুষ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ বন থেকে নিয়মিত আহরণ করা হয় মধু, মৌচাকের মোম, ঘর ছাওয়ার গোলপাতা, মাছ- কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি। এছাড়া অনেকগুলো শিল্প যেমন নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হাটবোর্ড, আসবাবপত্র, নৌকা, সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। এই বনে ব্যাপক প্রাণবৈচিত্র্য বিদ্যমান রয়েছে। যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, হরিণ, বানর, ভাল্লুক ইত্যাদি। তাছাড়া বোনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ওড়া, বাইন, কাঁকড়া, গোলপাতা সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তবে সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে প্রাণী ও বনের সম্পদ ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে।

ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরী। সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে আমাদের বহুমাতৃক সংকট ততই প্রকট হবে।

‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বনের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার প্রতিবছর এ বন থেকে মোট রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানী কাঠ সরবরাহ করে।

বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২৪ বছরে ৩২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের শরণখোলা , চাঁদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা এই চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে বা লাগানো হয়- তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
অথচ গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনে প্রায় ৫০ বার অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, কোন সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। শুধু আগুনে পুড়ছে না সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র। তারা সুন্দরবনের মধ্যে মাছ শুকানোর জন্য শুঁটকি মাছ জ্বালানোর কারখানায় আগুন জ্বালিয়ে অবাধে সুন্দরবনের কাঠ ব্যাবহার করে বন যেমন ধ্বংস করছে অপরদিকে তাদের অসাবধানতার কারণে সুন্দরবনে আগুন লাগার ও ঘটনা ঘটে।
উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় সুন্দরবনের কাঠ অবৈধভাবে জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহার করায় সুন্দরবন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অসাধু জেলেরা বিষ প্রয়োগে সুন্দরবন থেকে মাছ মারার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন বিলুপ্তির পথে, তেমনি বিষের প্রভাবে গাছ-গাছালিও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আর এবিষয়ে তাদেরকে সহযোগীতা করে থাকে কিছু অসাধু বনকর্মী। যাদের সহযোগীতায় এই অসাধু চক্র ও চোরা শিকারীরা থাকে ধরা-ছোয়ার বাইরে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বলেন, আগুন লাগার দায়ভার কোন ভাবেই বনবিভাগ এড়াতে পারে না। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মৌয়ালদের কারণেও আগুন লেগে থাকে।

মানব সৃষ্ট সুন্দরবনের পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড বন্ধে বনবিভাগ সহ সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। সুন্দরবনের মধ্যে মুনাফা লোভী ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে নদী- খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নদী- খালকে দূষণ ও দখল মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বনের ভিতরে মানুষের কিংবা বুনজীবীদের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে বনের উপর নীবিড় পর্যবেক্ষণ রাকতে হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষা শুধু কয়েক হাজার মানুষের জীবন- জীবিকার বিষয় নয় সুন্দরবন গোটা বাংলাদেশ, উপমহাদেশ তথা বিশ্বের পরিবেশের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য রক্ষাকবচ।

সুন্দরবন সুরক্ষার বিষয়ে ‘ইয়ুথ ফর সুন্দরবন’ কয়রা উপজেলা কমিটির আহবায়ক নিরাপদ মুন্ডা বলেন, এক্ষেত্রে মানব সৃষ্ট অনুঘটক গুলো প্রতিরোধ যেমন জরুরী, তেমনি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা দরকার। এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সেহেতু এর সুরক্ষা দানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।

তাই অগ্নিকাণ্ড ও বিষ প্রয়োগে মাছ মারার রহস্য উন্মোচন এবং এ ধরনের জঘন্য কর্মকান্ড বন্ধে বনবিভাগ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পরিবেশকর্মী, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সযন্বয়ে গ্রহণ করতে হবে তদন্ত কমিটি।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

সুন্দরবন সুরক্ষায় করণীয়

২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস

আপডেট সময় ০৭:২২:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের অংশ।

বৃহত্তর খুলনা বিভাগের কয়েক লক্ষ মানুষ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ বন থেকে নিয়মিত আহরণ করা হয় মধু, মৌচাকের মোম, ঘর ছাওয়ার গোলপাতা, মাছ- কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি। এছাড়া অনেকগুলো শিল্প যেমন নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হাটবোর্ড, আসবাবপত্র, নৌকা, সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। এই বনে ব্যাপক প্রাণবৈচিত্র্য বিদ্যমান রয়েছে। যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, হরিণ, বানর, ভাল্লুক ইত্যাদি। তাছাড়া বোনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ওড়া, বাইন, কাঁকড়া, গোলপাতা সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তবে সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে প্রাণী ও বনের সম্পদ ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে।

ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরী। সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে আমাদের বহুমাতৃক সংকট ততই প্রকট হবে।

‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বনের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। সরকার প্রতিবছর এ বন থেকে মোট রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানী কাঠ সরবরাহ করে।

বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২৪ বছরে ৩২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের শরণখোলা , চাঁদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা এই চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে বা লাগানো হয়- তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
অথচ গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনে প্রায় ৫০ বার অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, কোন সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। শুধু আগুনে পুড়ছে না সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র। তারা সুন্দরবনের মধ্যে মাছ শুকানোর জন্য শুঁটকি মাছ জ্বালানোর কারখানায় আগুন জ্বালিয়ে অবাধে সুন্দরবনের কাঠ ব্যাবহার করে বন যেমন ধ্বংস করছে অপরদিকে তাদের অসাবধানতার কারণে সুন্দরবনে আগুন লাগার ও ঘটনা ঘটে।
উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় সুন্দরবনের কাঠ অবৈধভাবে জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহার করায় সুন্দরবন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অসাধু জেলেরা বিষ প্রয়োগে সুন্দরবন থেকে মাছ মারার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন বিলুপ্তির পথে, তেমনি বিষের প্রভাবে গাছ-গাছালিও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আর এবিষয়ে তাদেরকে সহযোগীতা করে থাকে কিছু অসাধু বনকর্মী। যাদের সহযোগীতায় এই অসাধু চক্র ও চোরা শিকারীরা থাকে ধরা-ছোয়ার বাইরে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বলেন, আগুন লাগার দায়ভার কোন ভাবেই বনবিভাগ এড়াতে পারে না। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মৌয়ালদের কারণেও আগুন লেগে থাকে।

মানব সৃষ্ট সুন্দরবনের পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড বন্ধে বনবিভাগ সহ সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। সুন্দরবনের মধ্যে মুনাফা লোভী ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে নদী- খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নদী- খালকে দূষণ ও দখল মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বনের ভিতরে মানুষের কিংবা বুনজীবীদের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে বনের উপর নীবিড় পর্যবেক্ষণ রাকতে হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষা শুধু কয়েক হাজার মানুষের জীবন- জীবিকার বিষয় নয় সুন্দরবন গোটা বাংলাদেশ, উপমহাদেশ তথা বিশ্বের পরিবেশের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য রক্ষাকবচ।

সুন্দরবন সুরক্ষার বিষয়ে ‘ইয়ুথ ফর সুন্দরবন’ কয়রা উপজেলা কমিটির আহবায়ক নিরাপদ মুন্ডা বলেন, এক্ষেত্রে মানব সৃষ্ট অনুঘটক গুলো প্রতিরোধ যেমন জরুরী, তেমনি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা দরকার। এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সেহেতু এর সুরক্ষা দানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।

তাই অগ্নিকাণ্ড ও বিষ প্রয়োগে মাছ মারার রহস্য উন্মোচন এবং এ ধরনের জঘন্য কর্মকান্ড বন্ধে বনবিভাগ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পরিবেশকর্মী, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সযন্বয়ে গ্রহণ করতে হবে তদন্ত কমিটি।