১১ বছর আগে ছিলেন গুলশান থানার ওসি।সেই সময় বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশেষ বাধা দেওয়ার ঘটনায় আসেন আলোচনায়।ওই ঘটনার পরই কপাল খুলে যায় তার।পরপর দুদফা পদোন্নতি পান। ইন্সপেক্টর থেকে বনে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। বলছিলাম গুলশান থানার তৎকালীন সাবেক দাপুটে ওসি রফিকুল ইসলামের কথা।
২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা ‘মার্চ অব ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার লক্ষে অভিনব কৌশলে বালু বোঝাই ট্রাক রেখে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় আটকে দেওয়া হয়। অবরুদ্ধ করা হয় বিএনপির চেয়ারপারসনকে। এতে দলটির পূর্বনির্ধারিত মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি পুরোপুরি ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি খালেদা জিয়াকে কৌশলে অবরুদ্ধ করে রাখার ‘কারিগর’ ওসি রফিকের।পদোন্নতি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে তিনি ছিলেন গুলশান এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এমনকি ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত তিনি গুলশানেই কর্মরত ছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই রফিককে গুলশান থেকে সরিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওসি রফিকের বাড়ি মেহেরপুর। কিন্তু নিজেকে তিনি গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিতেন। এমনকি তার পরিবারের সদস্যদের অনেকে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এমন কথা বলতেন সগৌরবে। এছাড়া নিজেকে সৎ দাবি করে মহত্ত্বের নানা উদাহরণ টানতেন। হরহামেশা বলতেন গুলশান থানার ওসি হয়েও ঘুস নেন না। সৎ ওসি হিসাবে তিনি পুলিশ বাহিনীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অথচ বাস্তব চিত্র ঠিক এর উলটো। সুকৌশলে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান রফিক। রাজকীয় জীবনযাপনের কাছে দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের অনেকে হার মানে।
অভিজাত বাড়ি : রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের এক নম্বর রোডে ঢুকতেই সুরম্য ভবনটি সবার নজর কাড়ে। প্লট নম্বর ৫৬৬/৫৬৭। চার কাঠা জায়গার ওপর ৯ তলা সুরম্য ইমারত। আধুনিক স্থাপত্য নকশায় তৈরি ভবনটি সিঙ্গেল ইউনিটের। একেকটি সুপরিসর ফ্ল্যাটের আয়তন দুহাজার বর্গফুটের বেশি। রফিক বসবাস করেন ৫ম তলায়। ভবনের অন্য ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক রফিক।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের প্রবেশমুখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছেন দুজন পোশাকধারী নিরাপত্তা প্রহরী। বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ভবনের পার্কিংয়ে চারটি প্রাইভেট কার দেখা যায়। এর একটিতে (ঢাকা মেট্রো গ-৩৫-১৫৮৯) লেখা ‘পুলিশ’। বাকি গাড়িগুলো পর্দায় ঢাকা। নিচতলার একদিকে সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন গাড়িচালক।
ভবনে ঢোকার সময় এগিয়ে আসেন রফিকের গাড়িচালক বাদল। ভাড়াটিয়া পরিচয় দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বাদল বলেন, বর্তমানে কোনো ফ্ল্যাট খালি নেই। সর্বশেষ একটি ফ্ল্যাট খালি ছিল। সেটিও গত মাসে ভাড়া হয়ে গেছে। এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া প্রতি মাসে ৫৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসাবে অতিরিক্ত আরও ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। বাড়ি মালিকের নাম জানতে চাইলে সন্দেহের চোখে তাকান বাদল। এক পর্যায়ে বলেন, ‘মালিক গুলশানের ওসি (বর্তমানে এডিসি) রফিক স্যার। আরও কিছু জানার থাকলে গুলশান থানায় যান। তার সঙ্গে কথা বলেন।
বিদেশে স্ত্রী-সন্তান : রফিকের দুই সন্তান দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। সেখানে তারা ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এছাড়া রফিকের স্ত্রী আনজুমানারা বেগমও সন্তানদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। রফিক নিজেও অস্ট্রেলিয়া যাতায়াতের ওপর থাকেন। প্রতি বছর একাধিকবার তিনি ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।
যুগান্তরের মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, রফিকের বাবার নাম নইমুদ্দিন বিশ্বাস ওরফে নায়েব হাজি। মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। চার ভাইয়ের মধ্যে রফিক বড়। পুলিশে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি এসআই (উপপরিদর্শক) পদে চাকরি পান। তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রবাসী। এছাড়া তার এক ভাই ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন এবং আরেক ভাই গ্রামেই ছোটখাটো ব্যবসা করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম সোমবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ১৯৯৭ সালে মিশন থেকে ফিরে তিনি বসুন্ধরায় জমি কেনেন। পরে সেখানে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর অনুমোদন নিয়ে তিনি ফ্ল্যাট স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করেছেন। তিনি বলেন, আপনারা ভালো করেই জানেন আমি দুর্নীতিবাজ কি না। তারপরও এখন বৈরী সময় যাচ্ছে। অনেকে নানাভাবে কুৎসা রটাতে তৎপর।