ডেঙ্গুর তাণ্ডবে জর্জরিত গোটা দেশ। একের পর এক রেকর্ড ভেঙে ডেঙ্গু রোগী আর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের অতীতের সব রেকর্ড এরই মধ্যে ভেঙে তছনছ করে ফেলেছে। পেশায় আমি যেহেতু লিভারের ডাক্তার, তাই ডেঙ্গু সরাসরি আমার বিষয়, আবার বিষয়ও না। একটু ভেঙেই বলি।
যে ভাইরাসগুলো প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র লিভারে ইনফেকশন করে তাদেরকে আমরা চিনি হেপাটাইটিস ভাইরাস হিসেবে। যেমন হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ই ইত্যাদি।
সেই বিবেচনায় ডেঙ্গু আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে এসবের বাইরেও আরও কিছু ভাইরাস আছে যেগুলো মূলত লিভারেই ঝামেলা করে না ঠিকই, কিন্তু এসব ভাইরাসে লিভার ঠিকঠিকই আক্রান্ত হতে পারে। এই তালিকায় যেমন রয়েছে হালের সার্স-কোভ-২ বা কোভিড-১৯ ভাইরাস, তেমনি আছে ডেঙ্গু ভাইরাসও।
ফুসফুসের পর শরীরের যে অঙ্গে সার্স-কোভ-২ সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করেছে তার নাম লিভার। একইভাবে ডেঙ্গুতেও লিভার আক্রান্ত হওয়া আর লিভার ফাংশন কিছুটা হলেও এলোমেলো হয়ে যাওয়া মোটেও বিরল কোনো ঘটনা নয়।
কাজেই ডেঙ্গু রোগীর সাথে পেশাগত কারণে আমার মতো লিভার বিশেষজ্ঞেরও দেখা-স্বাক্ষাৎ নিত্যই। তাছাড়া ডেঙ্গুর এই বাড়বাড়ন্ত সময়ে আর দশজনের মতো আমাদের পরিচিতরাও যেহেতু ছাড় পাচ্ছেন না, কাজেই ডেঙ্গু আমাদের চর্চার মধ্যেই থাকছে। এসব কারণে ডেঙ্গু নিয়ে আমার যে সাম্প্রতিক ঘাঁটাঘাঁটি সেখান থেকে দু-একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা জরুরি।
ফুসফুসের পর শরীরের যে অঙ্গে সার্স-কোভ-২ সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করেছে তার নাম লিভার। একইভাবে ডেঙ্গুতেও লিভার আক্রান্ত হওয়া আর লিভার ফাংশন কিছুটা হলেও এলোমেলো হয়ে যাওয়া মোটেও বিরল কোনো ঘটনা নয়।
এবারে ডেঙ্গু কেন বাড়ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায় সিটি কর্পোরেশনের না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের, ডেঙ্গুর ভেক্টর নিয়ন্ত্রণে কোন সময়টায় ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি কিংবা জনসচেতনতা সৃষ্টি আর কী করা যেতে পারে।
আমার ধারণা ডেঙ্গুর এবারের ক্যাজুয়ালটির একটা বড় কারণ রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে উপস্থিতি। ডেঙ্গুর ধরন এবার অনেকটাই পাল্টে গেছে। এবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা খারাপ হচ্ছেন জ্বর পড়ে যাওয়ার পর।
এদেশের ডাক্তাররা এত দিনে এই বিষয় জানলে-বুঝলেও, এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের জানা আর বোঝার জায়গা এখনো অতটা স্বচ্ছ নয়। ফলে সঙ্গত কারণেই রোগীরা যখন মনে করছেন তারা ভালো হয়ে গেছেন, সেই সময়ে উল্টো তারা খারাপ হচ্ছেন আর ব্যাপারটা বুঝে উঠে হাসপাতালে আসতে আসতে তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আরও কিছু মানুষ আছেন যারা খারাপ হচ্ছেন প্লাটিলেটের অভাবে। আগে এক ইউনিট প্লাটিলেট জোগাড় করতে চার জন ডোনারের প্রয়োজন পড়তো, কিন্তু এখন এ্যাফেরেসিস মেশিন চলে আসায় একজন ডোনারের কাছ থেকেই এক ইউনিট প্লাটিলেট সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে।
তাছাড়া প্লাটিলেট বাড়াবার জন্য বাজারে কিন্তু খুব কার্যকর মুখে খাওয়ার ট্যাবলেটও আছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের এই শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতির সময়ে এলট্রোম্বোপ্যাগ নামের এই ওষুধ বাংলাদেশের একাধিক ওষুধ কোম্পানি এদেশে উৎপাদন এবং বাজারজাত করছে।
ওষুধ মূলত আইটিপি নামক একটি বিরল রক্ত রোগের হলেও আমরা লিভার বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে এই ওষুধ লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনে ব্যবহার করছি।
একে বলা হয় ওষুধের রিপারপাস করা আর এক রোগের ওষুধকে যখন অন্য রোগের চিকিৎসায় এভাবে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয় তখন তাকে বলা হয় ওষুধটির অব লেভেল ইন্ডিকেশন। এই যে এলট্রোম্বোপ্যাগ লিভার সিরোসিসের মতোই এর আরেকটি অফ লেভেল ইন্ডিকেশন হচ্ছে ডেঙ্গু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের একদল বিজ্ঞানী বছরখানেক আগে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় স্বল্প মেয়াদে এলট্রোম্বোপ্যাগ ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছিলেন এবং তাদের সেই গবেষণাপত্র নিউ ইংল্যান্ড জার্নালের মতো বিশ্বনন্দিত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
রোগীরা যখন মনে করছেন তারা ভালো হয়ে গেছেন, সেই সময়ে উল্টো তারা খারাপ হচ্ছেন আর ব্যাপারটা বুঝে উঠে হাসপাতালে আসতে আসতে তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে….
দেশের গবেষণার সেই ফলাফল ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা গেলে হয়তো ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট স্বল্পতাজনিত জটিলতাগুলো অনেক কমিয়ে নিয়ে আসা যেত। তবে এবারে যত রোগী প্লাটিলেট কমে গিয়ে ডেঙ্গুতে খারাপ হচ্ছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ডেঙ্গু রোগী খারাপ হচ্ছেন শকে চলে গিয়ে। এই শকের চিকিৎসায় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কারো প্রতি ইঙ্গিত না করে আমার একটা ধারণা শেয়ার করতে চাই। আমার ধারণা এই ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের জায়গা আমাদের সব পর্যায়ের চিকিৎসকেরা এখনো সেভাবে আত্মস্থ করে উঠতে পারেননি। ডেঙ্গুর ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের তথা সামগ্রিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যকর গাইডলাইন রয়েছে।
আর গাইডলাইন অনুযায়ী যাতে ডেঙ্গুর ম্যানেজমেন্ট ঠিকঠাক মতো করা হয় সেই বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং ডিসেমিনেশনেও ব্যবস্থাও রয়েছে। তারপরও এই জায়গায় দুর্বলতাটুকু সম্ভবত এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে এর একটা বড় কারণ হতে পারে এই যাত্রায় ডেঙ্গুর সহসা স্বভাব পরিবর্তন।
তবে এবারের ডেঙ্গু নিয়ে যা আমার সবচেয়ে বেশি নজরে এসেছে তা হলো ‘আতঙ্ক’। সচেতনতা, সঠিক সময় চিকিৎসা গ্রহণ আর সর্বাঙ্গে প্রতিরোধ সবকিছু ছাপিয়ে মানুষ এখন ডেঙ্গুজনিত আতঙ্ক কেন যেন বড় বেশি বড় করে দেখছেন।
কাজেই কোভিডকে যেমন আমরা ক’দিন আগে নিয়ন্ত্রণে এনে ছেড়েছি, তেমনি ডেঙ্গুকে বশে আনতেও যে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না এই বিষয়ে আমি আশাবাদী।