ঢাকা ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
দাউদকান্দি উপজেলা নবাগত ইউএন ও এসিল্যান্ড ভূমি ও পৌর প্রশাসক মো: জিয়াউর রহমান কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময় ভোলায় আজকের পত্রিকার পাঠক বন্ধুর উদ্যোগে মাদক বিরোধী র‌্যালি,সেমিনার ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত নতুন ব্রিজ এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে পথচারী জমির দলিলের প্রলোভানা দিয়ে গ্রাম পুলিশের নির্দেশে সোনিয়া আক্তার নামে এক নারীকে নির্যাতন করে আমরা আর কোনো অবিচার চাই না’ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালককে বদলি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রংপুরে বিক্ষোভ রিমান্ডে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন সাবেক ২ আইজিপি বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ফের উত্তাল আশুলিয়া, বন্ধ ৫২ কারখানা ট্রাইব্যুনালে প্রথমবার হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ

নিজস্ব প্রেসকিপশনে গ্রেফতার কি-না সন্দেহ আছে, বলছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত তিন দিনে আওয়ামী লীগ আমলের একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে একাধিক মামলা৷

এসব মামলার এজাহার ও আদালতে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত সরকারের সময় ঠিক যেভাবে মামলা, গ্রেফতার বা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তার ব্যতিক্রম নেই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও৷

এ ধরনের মামলায় প্রকৃত আসামিদের বিচার কতোটা সম্ভব আর আইনের ফাঁক দিয়ে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে কি-না, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন৷

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলছেন, ‘বর্তমান প্রক্রিয়া দেখে আমার মনে হচ্ছে, তারা আগের সরকারের প্রক্রিয়া ফলো করছে৷ বরং যারা গ্রেফতার হচ্ছেন, তারা তাদের নিজস্ব প্রেসকিপশনে গ্রেফতার হচ্ছেন কি-না তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে৷’

গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ নেতারা এ ধরনের ‘গেইম খেলতে খেলতে অভ্যস্ত’ বলে মনে করেন এই আইনজীবী৷ তিনি বলেন, ‘যে মামলায় তারা গ্রেফতার হচ্ছেন, সেখানে তাদের যদি সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকে বা ইন্ধনদাতা হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা যাবে না৷ যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের অপরাধ তো অন্য জায়গায়৷ সেটা যতটা না খুনের, তত বেশি দুর্নীতি, অর্থপাচারের৷ তারা তো বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে৷ শেয়ারবাজার কেলেংকারির পুরনো ঘটনা তো আছেই৷’

আওয়ামী লীগের নেতারা নানা ধরনের ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জানিয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সেই মামলাগুলো করা প্রয়োজন৷ আইনি ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফেরানোটা জরুরি৷ আমার মনে হয়, সরকারের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে একটা প্ল্যান অব অ্যাকশন পাওয়াটা জরুরি৷ সেটা এখনও আমরা পাইনি৷’

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বগুড়ায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০১ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলা ও দুটি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে৷ সবগুলোতে হত্যার অভিযোগ৷ এর মধ্যে বগুড়ার মামলাটি হয়েছে থানায়৷ এছাড়া ঢাকার আদালতে চারটি মামলা করা হয়েছে৷ এর বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ সবগুলো মামলাতেই শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷

এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভির হাসান সৈকত ও ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (সদ্য অবসরে পাঠানো) জিয়াউল আহসান৷ এর মধ্যে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসানকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে (২৪) হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে৷

এছাড়া পলক, টুকু ও সৈকতকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে পল্টন থানায় রিকশাচালক কামাল মিয়া (৩৯) হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে৷

এই দুটি মামলার এজাহার ও আদালতে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলার কোথাও আসামিদের নাম নেই৷ সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা হিসেবে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে৷ গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন৷ মামলায় সব আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয়৷

মামলার অভিযোগে আয়শা বেগম উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তার ছেলের মোবাইল থেকে ফোন করে জানায়, শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে ভর্তি৷ সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক পপুলার হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, তার ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মর্গ থেকে ছেলেন মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি৷ অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা তার ছেলের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করেছে৷ ফলে তার ছেলে রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন৷

গত ২০ জুলাই পল্টন এলাকায় রিকশাচালক কামাল মিয়া হত্যা ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৩৬) বাদি হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোনে তিনি জানতে পারেন, তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন৷ তাকে উদ্ধার করে পথচারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷ এই মামলাতেও কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি৷

হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট এয়ারপোর্ট থেকে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷ তখন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, তাকে একটি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ অথচ ১৪ আগস্ট তাকে নিকুঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার দেখানো হলো৷ আগের সরকারের সময়ও একই ধরনের অভিযোগ ছিল যে, এক জায়গা থেকে ধরে নিয়ে অন্য জায়গা থেকে গ্রেফতার দেখানো হতো৷

অপরদিকে অভিযুক্তদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না৷ এমনকি তাদের আদালতে নেওয়ার সময় অন্য আইনজীবীরা ডিম নিক্ষেপ করেছেন৷ আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি৷ যারা দাঁড়াতে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে কয়েকজন আইনজীবী দুর্ব্যবহার করেছেন৷ সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের রিমান্ড আবেদন শুনানিতে আইনজীবীরা কথা বলতে না পারলেও শামসুল হক টুকু, জুনাইদ আহমেদ পলক ও তানভীর হাসান সৈকতের ক্ষেত্রে একজন আইনজীবী সংক্ষিপ্ত শুনানি করেছেন৷

এদিন আদালত প্রাঙ্গণ ও এজলাসের ভেতরে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আসামিদের ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন৷ আসামিদের পক্ষে আইনজীবী আতাউর রহমান শুনানি করতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ওকালতনামা দেওয়া যাবে না বলে চিৎকার করতে থাকেন৷ বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চাপের মুখে সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন আতাউর রহমান৷

তিনি বলেন, ‘আমি এই তিনজনের পক্ষে ওকালতনামা জমা দিলাম৷ আমি তাদের জামিন চাই৷’

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষ হওয়ার মিনিট দশেক পর আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে মহানগর হাকিম রশিদুল আলম এজলাস ছেড়ে খাসকামরায় চলে যান৷

ব্রিটিশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান এক্স (আগের টুইটার) হ্যান্ডেলে নিজের দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘এটি অত্যন্ত ভয়ানক৷ ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে বিচারকার্য চালিয়ে গেলেন? এ ধরনের মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে যদি না পুলিশ ও আদালতকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় যে তাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা হয়৷ সেই প্রত্যাশা হলো আইনের ন্যায্য প্রয়োগের পাশাপাশি পেশাদারিত্বের একটি স্তর প্রদর্শন করা, যা এখন এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না৷’

এখনও যদি অভিযুক্তের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে দেওয়া না হয় তাহলে পরিস্থিতির কি পরিবর্তন হলো? জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘মানুষ চায় পরিস্থিতির বদল হোক৷ বৈষম্যবিরোধী পরিস্থিতির জন্যই তো ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল৷ তাদেরও কিন্তু নিশ্চিত করা দরকার যে, কারো প্রতি বৈষম্য না হয়৷ আগের সরকারের সময় তো দেখেছেন, যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু তারপরও আইনজীবীদের বাধা দেওয়া হয়নি৷ তাদের পক্ষে আইনজীবীরা কথা বলেছেন৷’

অপরাধী যে-ই হোক তার পক্ষে তো আইনজীবীকে কথা বলতে দিতে হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী৷ তিনি বলেন, ‘কথা বলতে না দিলে তো বৈষম্যই থেকে গেল৷ পরিস্থিতির তো বদল হলো না৷ এমন চলতে থাকলে মানুষের প্রত্যাশার উপর চিড় ধরবে৷ তারা হতাশ হবেন৷ তারা মনে করবেন, কিছুই হবে না৷ শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন মাত্র৷’

এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বাকের মজুমদার বলেন, ‘আমরা আসলে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছি৷ এখনও এদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হয়নি৷ তবে আমরা শিগগিরই এই বিষয়গুলো দেখব৷ সত্যিকারে যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরে আনব৷ যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হন৷ অবশ্যই প্রত্যেকের আইনজীবী পাওয়ার অধিকার আছে৷’

আওয়ামী লীগের ভুল থেকে কি বিএনপি কোনো শিক্ষা নিয়েছে কি-না জানতে চাওয়া হয় দলটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের কাছে৷ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আগে যেটা হয়েছে, এখন সেটা হবে না৷’

আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের আদালতে নেওয়া হয়েছে, তারা গণধিকৃত ব্যক্তি৷ ফলে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক আক্রোশ হয়তো তাদের বিরুদ্ধে ছিল৷ আর এখনও তো আদালতের পিপি, এপিপিসহ সবাই আগের সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া৷ তবে আমরা নিশ্চিত করব, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি আর না হয়৷’

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

দাউদকান্দি উপজেলা নবাগত ইউএন ও এসিল্যান্ড ভূমি ও পৌর প্রশাসক মো: জিয়াউর রহমান কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময়

নিজস্ব প্রেসকিপশনে গ্রেফতার কি-না সন্দেহ আছে, বলছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

আপডেট সময় ০৩:১৪:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত তিন দিনে আওয়ামী লীগ আমলের একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে একাধিক মামলা৷

এসব মামলার এজাহার ও আদালতে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত সরকারের সময় ঠিক যেভাবে মামলা, গ্রেফতার বা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তার ব্যতিক্রম নেই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও৷

এ ধরনের মামলায় প্রকৃত আসামিদের বিচার কতোটা সম্ভব আর আইনের ফাঁক দিয়ে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে কি-না, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন৷

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলছেন, ‘বর্তমান প্রক্রিয়া দেখে আমার মনে হচ্ছে, তারা আগের সরকারের প্রক্রিয়া ফলো করছে৷ বরং যারা গ্রেফতার হচ্ছেন, তারা তাদের নিজস্ব প্রেসকিপশনে গ্রেফতার হচ্ছেন কি-না তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে৷’

গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ নেতারা এ ধরনের ‘গেইম খেলতে খেলতে অভ্যস্ত’ বলে মনে করেন এই আইনজীবী৷ তিনি বলেন, ‘যে মামলায় তারা গ্রেফতার হচ্ছেন, সেখানে তাদের যদি সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকে বা ইন্ধনদাতা হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা যাবে না৷ যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের অপরাধ তো অন্য জায়গায়৷ সেটা যতটা না খুনের, তত বেশি দুর্নীতি, অর্থপাচারের৷ তারা তো বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে৷ শেয়ারবাজার কেলেংকারির পুরনো ঘটনা তো আছেই৷’

আওয়ামী লীগের নেতারা নানা ধরনের ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জানিয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সেই মামলাগুলো করা প্রয়োজন৷ আইনি ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফেরানোটা জরুরি৷ আমার মনে হয়, সরকারের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে একটা প্ল্যান অব অ্যাকশন পাওয়াটা জরুরি৷ সেটা এখনও আমরা পাইনি৷’

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বগুড়ায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০১ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলা ও দুটি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে৷ সবগুলোতে হত্যার অভিযোগ৷ এর মধ্যে বগুড়ার মামলাটি হয়েছে থানায়৷ এছাড়া ঢাকার আদালতে চারটি মামলা করা হয়েছে৷ এর বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ সবগুলো মামলাতেই শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷

এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভির হাসান সৈকত ও ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (সদ্য অবসরে পাঠানো) জিয়াউল আহসান৷ এর মধ্যে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসানকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে (২৪) হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে৷

এছাড়া পলক, টুকু ও সৈকতকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে পল্টন থানায় রিকশাচালক কামাল মিয়া (৩৯) হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে৷

এই দুটি মামলার এজাহার ও আদালতে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলার কোথাও আসামিদের নাম নেই৷ সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা হিসেবে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে৷ গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন৷ মামলায় সব আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয়৷

মামলার অভিযোগে আয়শা বেগম উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তার ছেলের মোবাইল থেকে ফোন করে জানায়, শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে ভর্তি৷ সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক পপুলার হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, তার ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মর্গ থেকে ছেলেন মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি৷ অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা তার ছেলের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করেছে৷ ফলে তার ছেলে রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন৷

গত ২০ জুলাই পল্টন এলাকায় রিকশাচালক কামাল মিয়া হত্যা ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৩৬) বাদি হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোনে তিনি জানতে পারেন, তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন৷ তাকে উদ্ধার করে পথচারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷ এই মামলাতেও কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি৷

হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট এয়ারপোর্ট থেকে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷ তখন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, তাকে একটি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ অথচ ১৪ আগস্ট তাকে নিকুঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার দেখানো হলো৷ আগের সরকারের সময়ও একই ধরনের অভিযোগ ছিল যে, এক জায়গা থেকে ধরে নিয়ে অন্য জায়গা থেকে গ্রেফতার দেখানো হতো৷

অপরদিকে অভিযুক্তদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না৷ এমনকি তাদের আদালতে নেওয়ার সময় অন্য আইনজীবীরা ডিম নিক্ষেপ করেছেন৷ আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি৷ যারা দাঁড়াতে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে কয়েকজন আইনজীবী দুর্ব্যবহার করেছেন৷ সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের রিমান্ড আবেদন শুনানিতে আইনজীবীরা কথা বলতে না পারলেও শামসুল হক টুকু, জুনাইদ আহমেদ পলক ও তানভীর হাসান সৈকতের ক্ষেত্রে একজন আইনজীবী সংক্ষিপ্ত শুনানি করেছেন৷

এদিন আদালত প্রাঙ্গণ ও এজলাসের ভেতরে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আসামিদের ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন৷ আসামিদের পক্ষে আইনজীবী আতাউর রহমান শুনানি করতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ওকালতনামা দেওয়া যাবে না বলে চিৎকার করতে থাকেন৷ বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চাপের মুখে সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন আতাউর রহমান৷

তিনি বলেন, ‘আমি এই তিনজনের পক্ষে ওকালতনামা জমা দিলাম৷ আমি তাদের জামিন চাই৷’

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষ হওয়ার মিনিট দশেক পর আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে মহানগর হাকিম রশিদুল আলম এজলাস ছেড়ে খাসকামরায় চলে যান৷

ব্রিটিশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান এক্স (আগের টুইটার) হ্যান্ডেলে নিজের দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘এটি অত্যন্ত ভয়ানক৷ ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে বিচারকার্য চালিয়ে গেলেন? এ ধরনের মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে যদি না পুলিশ ও আদালতকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় যে তাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা হয়৷ সেই প্রত্যাশা হলো আইনের ন্যায্য প্রয়োগের পাশাপাশি পেশাদারিত্বের একটি স্তর প্রদর্শন করা, যা এখন এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না৷’

এখনও যদি অভিযুক্তের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে দেওয়া না হয় তাহলে পরিস্থিতির কি পরিবর্তন হলো? জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘মানুষ চায় পরিস্থিতির বদল হোক৷ বৈষম্যবিরোধী পরিস্থিতির জন্যই তো ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল৷ তাদেরও কিন্তু নিশ্চিত করা দরকার যে, কারো প্রতি বৈষম্য না হয়৷ আগের সরকারের সময় তো দেখেছেন, যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু তারপরও আইনজীবীদের বাধা দেওয়া হয়নি৷ তাদের পক্ষে আইনজীবীরা কথা বলেছেন৷’

অপরাধী যে-ই হোক তার পক্ষে তো আইনজীবীকে কথা বলতে দিতে হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী৷ তিনি বলেন, ‘কথা বলতে না দিলে তো বৈষম্যই থেকে গেল৷ পরিস্থিতির তো বদল হলো না৷ এমন চলতে থাকলে মানুষের প্রত্যাশার উপর চিড় ধরবে৷ তারা হতাশ হবেন৷ তারা মনে করবেন, কিছুই হবে না৷ শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন মাত্র৷’

এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বাকের মজুমদার বলেন, ‘আমরা আসলে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছি৷ এখনও এদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হয়নি৷ তবে আমরা শিগগিরই এই বিষয়গুলো দেখব৷ সত্যিকারে যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরে আনব৷ যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হন৷ অবশ্যই প্রত্যেকের আইনজীবী পাওয়ার অধিকার আছে৷’

আওয়ামী লীগের ভুল থেকে কি বিএনপি কোনো শিক্ষা নিয়েছে কি-না জানতে চাওয়া হয় দলটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের কাছে৷ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আগে যেটা হয়েছে, এখন সেটা হবে না৷’

আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের আদালতে নেওয়া হয়েছে, তারা গণধিকৃত ব্যক্তি৷ ফলে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক আক্রোশ হয়তো তাদের বিরুদ্ধে ছিল৷ আর এখনও তো আদালতের পিপি, এপিপিসহ সবাই আগের সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া৷ তবে আমরা নিশ্চিত করব, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি আর না হয়৷’