জীবন ধারণে অপরিহার্য বিষয় হলো পানাহার। পানাহার ছাড়া মানুষের জীবন রক্ষা অসম্ভব। শক্তি জোগাতে পানাহার করতেই হয়। এর বিকল্প কিছু নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর। পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না। -(সুরা আরাফ, ৩১)
খাদ্য গ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও জীবনের প্রতিটি বিধানের মতো খাবারের ক্ষেত্রেও শিষ্টাচার ও বিধি নিষেধ শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর রাসুল। বিধি-নিষেধগুলোর প্রতি একটু খেয়াল রাখলেই খাবারও ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়, এতেও সওয়াব লাভ হয়।
নবীজি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে জীবনের প্রতিটি বিষয়, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয় আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। ’ -(সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৯)
তিনি পানাহারের সুন্নতও শিক্ষা দিয়েছেন উম্মতকে। এখানে পানাহারের কয়েটি সুন্নত তুলে ধরা হলো।
দোয়া পড়ে শুরু করা
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের শুরুতেই দোয়া পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। কারণ দোয়া না পড়লে খাবারে বরকত কমে যায়। শয়তানও সেই খাবারে অংশ নেয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও খাওয়ার শুরুতে সব সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলতেন এবং তাঁর সঙ্গীদেরও তা বলতে উৎসাহিত করতেন।
আল্লাহর রাসুল বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে এবং ডান হাতে খাবার খাও। এবং তোমার দিক থেকে খাও।’ (বুখারি, হাদিস: ৫১৬৭; তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৩)।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘যখন তোমরা খাবার খেতে শুরু করো, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও, তাহলে বলো— বিসমিল্লাহি আওওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু। (রিয়াজুস সালেহিন: ৭২৯)
খাওয়ার আগে-পরে হাত ধোয়া
খাওয়ার আগে হাত ধোয়া মুস্তাহাব। খাওয়ার পরে হাত ধোয়া সুন্নত। (তুহফাতুল আহওয়াজি: ৫ / ৪৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৭৪৮৬; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪৯৩)
ডান হাতে খাওয়া
রাসুল (সা.) আজীবন ডান হাত দিয়ে খাবার খেয়েছেন এবং বাঁ হাত দিয়ে খাবার খেতে নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বাম হাত দিয়ে পানাহার কোরো না। কেননা, শয়তান বাম হাতে পানাহার করে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১২)
দস্তরখান ব্যবহার করা
খাবার পড়ে গেলে তুলে খাওয়া মহানবী (সা.)-এর সুন্নত। এই সুন্নত আদায়ের জন্য আরেকটি সহায়ক আদব হলো দস্তরখান বিছানো। নবী (সা.) চামড়ার দস্তরখানায় খাবার খেতেন। (বুখারি, হাদিস: ৫৪১৫)। দস্তরখানা পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া যায়।
প্লেটের একপাশ থেকে খাওয়া
খাবার প্লেটের এক পাশ থেকে খাওয়া সুন্নত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যখানে বরকত নাজিল হয়। তোমরা একপাশ থেকে খাও। মধ্যখান থেকে নয়।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৮০৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩২৭৭)
পড়ে গেলে উঠিয়ে খাওয়া
খাওয়ার সময় কিছু পড়ে গেলে তা উঠিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে খাওয়া সুন্নত। মহানবী (সা.) এমনটি করার নির্দেশনা দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৪২১৮; মুসলিম, হাদিস: ২০৩৪)
খাবারের দোষ না ধরা
রাসুল (সা.) কখনো খাবারের দোষ ধরতেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কখনো খাবারের দোষত্রুটি ধরতেন না। তাঁর পছন্দ হলে খেতেন আর অপছন্দ হলে ত্যাগ করতেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৫১৯৮, ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৩৮২)
যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা
ঘরে সব সময় ভালো খাবার থাকে না। তাই যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা মহানবী (সা.)-এর সুন্নত। (মুসলিম, হাদিস: ২০৫২)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার নিয়ামতগুলোর কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য আমার নিয়ামত বাড়িয়ে দেব।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৭)।
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘…যদি তোমরা আমার এ নিয়ামতগুলোকে অস্বীকার করো, তাহলে জেনে রাখো, আমার আজাব বড়ই কঠিন।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৭)।
হজরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রুটি খাওয়ার জন্য) তরকারি চাইলেন। ঘর থেকে জানানো হল, তরকারি হিসেবে সিরকা ছাড়া আর কিছু নেই। তখন নবীজী বললেন, সেটাই পেশ কর। নবীজী সিরকা দিয়ে রুটি খাচ্ছিলেন আর বলছিলেন,
نِعْمَ الْأُدُمُ الْخَلّ، نِعْمَ الْأُدُمُ الْخَلّ
সিরকা তো অনেক ভালো তরকারি, সিরকা তো অনেক ভালো তরকারি! -(সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫২)
খাবার অপচয় না করা
খাবার অপচয় করা কঠিন গুনাহ। কোরআনে আল্লাহ তাআলা অপচয়কারীকে ‘শয়তানের ভাই’ আখ্যা দিয়েছেন। অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা: আরাফ, আয়াত: ৩১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সীমালঙ্ঘন ও অহংকার না করে খাও, দান কর এবং পরিধান কর।’ (নাসাঈঃ ৫/৭৯, ইবনে মাজা ৩৬০৫)
অন্যত্র নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
বনী আদম যা কিছু পূর্ণ করে এর মধ্যে পেট পরিপূর্ণ করা সবচেয়ে নিন্দনীয়। খাবার এতটুকু খাওয়াই যথেষ্ট, যতটুকু খেলে মাজা সোজা করে দাঁড়ানো যায়। এর চেয়ে বেশি যদি খেতে হয় তাহলে, পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবারের জন্য। একভাগ পানীয়ের জন্য। একভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখা। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৮০)
খাওয়ার সময় কেউ এলে তাঁকে ডাকা
খাওয়ার সময় বাইরে থেকে কেউ এলে তাঁকে খাবারের দস্তরখানে ডাকা মহানবী (সা.)-এর সুন্নত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩২৯৯)
একবার নবীজী খানা খাচ্ছিলেন, তখন এক ব্যক্তি এল। নবীজী তাকে বললেন, এসো, আমার সাথে খাও। -(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩২৯৯)
নবীজীর সাহাবীগণও এমনটি করতেন। যাহদাম জারমী রাহ. বলেন, আমি আবু মূসা রা.-এর কাছে গেলাম। তখন তিনি মুরগির গোস্ত খাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, এসো, আমার সাথে (মুরগির গোস্ত) খাও। আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা খেতে দেখেছি। (জামের তিরমিজি, হাদীস ১৮২৬)
আঙুল ও প্লেট চেটে খাওয়া
খাবার গ্রহণের পর আঙুল ও প্লেট চেটে খাওয়ার কথা বলেছেন মহানবী (সা.)। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ খাবার খেলে আঙুল চেটে না খেয়ে হাত মুছবে না। কারণ সে জানে না, কোন খাবারে বরকত আছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৩৮০৯; মুসলিম, হাদিস: ২০৩৩)