বর্তমানে তরুণেরা যেভাবে বিসিএসমুখী হচ্ছেন, সেটা আমাদের জন্য ‘অশনি সংকেত’ই বলা চলে। যিনি ডাক্তারি পাস করেছেন, যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন, যিনি এমবিএ করেছেন, যিনি সামাজিকবিজ্ঞান বা কলা অনুষদ থেকে পাস করেছেন—তাদের প্রায় সবারই লক্ষ্য বিসিএস অ্যাডমিন, পুলিশ, পররাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো বিসিএস ক্যাডার।
তাদের অধিকাংশই কেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিল্পী, সাহিত্যিক, আইটি বিশেষজ্ঞ, নির্মাতা হতে চান না? কেন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বিজ্ঞানী পদে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না? কেবল কি বিসিএসের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণগত সমৃদ্ধি সম্ভব?
আমি মনে করি, এর মূলে মোটাদাগে দুটি সমস্যা বিদ্যমান। প্রথমত, বিসিএসে কিছু সংখ্যক ক্যাডার পদ ব্যতীত অন্যরা যার যার পেশায় যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান পান না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষার কারিকুলাম একবিংশ শতাব্দী কিংবা আমাদের দেশের বা বাইরের দেশের কর্মোপযোগী নয়। আমাদের দেশের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী যখন ফেসবুক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? কিংবা ফেসবুকের সদর দপ্তর কোথায় অবস্থিত?—এমন সব প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ আর মনে থাকা না থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন কিংবা ব্যতিব্যস্ত, ঠিক তখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ফেসবুকে চাকরি করেন!
বর্তমানে ভারতে ফেসবুকের মূল কোম্পানি ‘মেটা’-এর ৫টি অফিস রয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, গুরুগ্রাম ও বেঙ্গালুরে এই ৫টি অফিস অবস্থিত এবং সেখানে প্রায় ৪,০০ ভারতীয় নাগরিক সম্মানজনক বেতনে চাকরি করেন।
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সবার ব্যর্থতা যে আমরা শিক্ষার্থীদের বিসিএস, ব্যাংক, সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারছি না…
‘স্ট্যাটিস্টিকা’-এর ২০২২ সালের তথ্যমতে, বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। তাহলে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের (মেটা) একটি অফিসও বাংলাদেশে না থাকা কি দুঃখজনক নয়?
এখানে আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের তরুণ-তরুণীরা বা কর্তৃপক্ষ কি এসব নিয়ে ভাবেন? আসলে এটা আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সবার ব্যর্থতা যে আমরা শিক্ষার্থীদের বিসিএস, ব্যাংক, সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারছি না কিংবা অন্য কিছু হওয়ার জন্য বা করার জন্য চিন্তার খোরাক জোগাতে পারি না।
সবাই কেন বিসিএস, ব্যাংক কিংবা সরকারি চাকরিমুখী হবে? কেন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু তরুণ-তরুণী নন-ক্যাডার চাকরির জন্য দিন-রাত আন্দোলন করতে যাবেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম-কমিশন-এর কার্যালয়ের সামনে?
তরুণ-তরুণীরা কেন মেটা, গুগল, টুইটার, অ্যামাজন, লাইকি, টিকটক, ইউটিউব, মাইক্রোসফটের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির স্বপ্ন দেখতে পারেন না? কেন তারা বড় বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন না?
তারপরও এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক তরুণ-তরুণীরা যখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন-আশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে মাঝপথে ঝরে পড়েন, আমরা কি তাদের খবর রাখি? আমরা কি, এসব নিয়ে গবেষণা করি, তারা কেন সফল উদ্যোক্তা হতে পারলেন না? তা নিয়ে গবেষণা হলেও আমরা কি সেই গবেষণার ফলাফল সমস্যা সমাধানে বাস্তবায়ন করি? এসব নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
সবাই কেন বিসিএস, ব্যাংক কিংবা সরকারি চাকরিমুখী হবে? কেন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু তরুণ-তরুণী নন-ক্যাডার চাকরির জন্য দিন-রাত আন্দোলন করতে যাবেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম-কমিশন-এর কার্যালয়ের সামনে?
আমি দেখেছি, আমাদের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী কাজ করতে পছন্দ করেন। অর্থাৎ, তারা কাজ করতে আগ্রহী। এই বিষয়টা আমার কাছে খুবই ইতিবাচক মনে হয়। প্রয়োজন তাদের এই কর্মস্পৃহা কাজে লাগানোর জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। কর্ম উপযোগী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম তৈরি করা।
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং খাত বাংলাদেশের জন্য এক সম্ভাবনাময় খাত। ফ্রিল্যান্সিং খাত থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলার আয় করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সারদের ৬৪ শতাংশই বাংলাদেশি। বর্তমানে বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বাজার প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। এই বাজারে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। কর্মী সরবরাহের হিসাবে যা বিশ্বে দ্বিতীয়। অথচ আয়ের দিক থেকে অষ্টম।
আমরা যদি এই সেক্টরে আরও জোর দিতে পারি, তাহলে আয়ের দিক থেকে তা প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারে। সেজন্য, জেলায় জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় বা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘সরকারি ফ্রিল্যান্সিং ইন্সটিটিউট’ স্থাপন করা যেতে পারে।
যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আরও দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি হবে এবং দেশের ডলার আয় বাড়বে এবং বেকারত্বের হার কমবে। অনেক পরিবার নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে।