আজ দুনিয়াতে সোয়াশ’ কোটি মুসলমান। তাদের হাতে পর্যাপ্ত মাল-সম্পদ সর্বোপরি আল্লাহ্ তায়ালার মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীম ও অমূল্য হাদীস গ্রন্থসমূহ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা আজ বিধর্মীদের হাতে অপমানিত-লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং কেনই বা তাদের ভাগ্যে পরাজয়ের গ্লানি নেমে এসেছে?
যে জাতি এক কালে শৌর্য-বীর্যে সমগ্র বিশ্বের শীর্ষে আরোহণ করেছিল, অর্ধ পৃথিবী যাদের করতলগত হয়েছিল, যাদের এক অঙ্গুলী হেলনে সারা বিশ্ব থরথর করে কেঁপে উঠতো। যেসব দেশ এককালে মূল ইসলামী ধারার কেন্দ্রভূমি বলে গর্ববোধ করতো, তাদের কেন আজ এ দৈন্যদশা ?
এ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যা ঘটে যাচ্ছে তার প্রতিটির পেছনেই কোন না কোন কারণ রয়েছে। মুসলমানদের এই অধঃপতনের পেছনেও অবশ্যই কোন কারণ আছে। কাজেই সময় এসেছে এ কারণ উদঘাটনের। বস্তুতঃ আত্মজিজ্ঞাসা ও নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে উদঘাটন করতে হবে এর মূল কারণ।আসলে এর মূকারণ হলো, মুসলমানরা আজ আল্লাহর দেওয়া বিধান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। মুসলমানরা আজ নানা মত-পথে দ্বিধা বিভক্ত।
এমন কি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, খুনাখুনী, সামাজিক ও ধর্মীয় দলাদলি এমন এক বিকট আকার ধারণ করেছে, যা কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেকেই নিজেদেরকে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী মনে করছে। নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করছে। সর্বোপরি মুসলমানদের যে মূল কাজ তথা দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তৎপরতা থাকার কথা, তা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে।
ফলশ্রুতিতে দূর অতীতে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় তথা জাহিলিয়্যাতের যুগে আরবের মানুষের যে নৈতিক পতন-অবক্ষয় ও ধ্বংস নেমে এসেছিল, তার চেয়ে অবর্ণনীয় ও ভয়াবহ চিত্র আমাদের সমাজ জীবনে পরিস্ফূট হয়ে উঠছে দিনদিন।
বস্তুতঃ আল্লাহ্ তায়ালার মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য তো এই যে, মানুষ আল্লাহর যমীনে একমাত্র আল্লাহর দ্বীন তথা বিধান প্রতিষ্ঠা করবে। সেই লক্ষ্যে মানুষ কালেমার দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে মানুষকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করবে। একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও ত্যাগ-তিতীক্ষার দ্বারা একটি সুখী সমাজ গড়ে তুলবে এবং পরম স্রষ্টার মাহাত্ম ঘোষণা করবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আল্লাহর সেই মহান উদ্দেশ্য আধুনিক জড়বাদী-ভোগবাদী, ধনতান্ত্রিক ও স্বার্থসর্বস্ব দুনিয়ায় ফলপ্রসু হচ্ছে না।
স্বার্থের বশবর্তী হয়ে মুসলমানরা আজ ইসলামের মূল লক্ষ্য, আদর্শ ও ঐতিহ্য পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। নিজ স্বার্থের তাকিদে একজন মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করছেনা। এমনকি স্বীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
আধুনিক বস্তুবাদী ভোগবাদী ও জড়বাদী সভ্যতার বিনাসী ভাইরাস আমাদের বিশ্বাসী জীবনকে প্রতিনিয়ত সংক্রামক রোগের ন্যায় সংক্রমিত করছে। ফলশ্রুতিতে সংক্রামিত মানুষগুলো আচার-আচরণে পশুকেও ছাড়িয়ে গেছে। খোদায়ী শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ নানা দল ও ফিরকায় শতধা বিভক্ত হয়ে আমরা এক দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছি। আর তাই বাতিল ও তাগুতী শক্তি সমগ্র পৃথিবী থেকে ইসলামের নাম নিশানা সমূলে মুছে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আমরা এক আল্লাহর বান্দা এবং সর্বশেষ্ঠ ও শেষ নবীজীর উম্মত, দ্বীনের যিম্মাদার ও মেহনতকারী, এ বোধ বিশ্বাস আর নেই। পবিত্র কুরআনের মূলনীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে গেছি।
ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল তথা দাওয়াত ও তাবলীগের মুবারক মেহনত ভুলে গেছি। আর তাই সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা নানাভাবে মার খাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। নানা অত্যাচার, যুলুম ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশের ভেতরে বাইরে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে।
আসলে পর্যাপ্ত দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনত না থাকার কারণে বিশ্বময় আজ দ্বীনহীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাহিল, বেদ্বীন, নাস্তিক, মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষী পয়দা হচ্ছে। ঘরে ঘরে ইসলামী তা’লীম না থাকায় দ্বীন ইসলাম শিক্ষার উপর দুনিয়ার জ্ঞান শিক্ষার প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মানুষ আল্লাহ্ মুখী না হয়ে গোমরাহীর পথে ধাবিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই যে মুসলমানদের পতন, অবক্ষয়-ধ্বংস প্রভৃতি থেকে কি উত্তরণের কোন পথ নেই? নিশ্চিত ধ্বংস থেকে এসব অগণিত মানব সন্তানকে কে রক্ষা করবে? আদম সন্তানের এ চরম ধ্বংস দেখে কি আমরা নিশ্চুপ থাকবো? নাকি এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে এমনি চিন্তা-ভাবনা করাটা নেহায়েত একটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কি হতে পারে? প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কখনও নিশ্চুপ থাকতে পারেনা।
বস্তুতঃ আমরা যদি এ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করি, তবে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ থেকে উত্তরণের একটি মাত্রই পথ খোলা আছে। আর তা হলো, আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সেই পথে চলা।
স্মর্তব্য, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের অন্ধকার ও বর্বরতার যুগে চরম অধঃপতিত মানুষদেরকে মহান এক শাশ্বত কালেমার দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনতের মাধ্যমে এক অখণ্ড ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ্ তৈরী করেছিলেন।
বস্তুতঃ হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মহান কালেমার দাওয়াত ও দ্বীনের যবরদস্ত মেহনতের দ্বারা সাহাবায়ে কিরামদের গাফেল অন্তরকে পরিবর্তন করেছিলেন এবং এক্বীন, ইখলাস, মুআমালা ও মুআশারা (পারস্পরিক লেন-দেন ও সামাজিকতা) ঠিক করেছিলেন, সেই মেহনত আজকে সবচেয়ে বেশী জরুরী হয়ে পড়েছে।
প্রতিটি মুসলমানের মুক্তির জন্য মযবুত ঈমান-এক্বীন, সুন্দর আখলাক ও আমল একান্ত প্রয়োজন। কেননা, ঈমান বা বিশ্বাস দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি। এর উপর যে অটল থাকতে পারে, সে-ই দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবী হাসিল করতে পারে।
ঈমান হলো, গায়েব বা অদেখার উপর বিশ্বাস। এটা অর্জন করা বড় কঠিন। এটা অর্জন করতে হলে ঈমানের দাওয়াত ও জানমালসহ দ্বীনের মেহনত ও মুজাহাদা প্রয়োজন। আর তাই প্রত্যেকেরই মুবারক ঈমানের দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনতের কাজ।