ঢাকা ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
দাউদকান্দি উপজেলা নবাগত ইউএন ও এসিল্যান্ড ভূমি ও পৌর প্রশাসক মো: জিয়াউর রহমান কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময় ভোলায় আজকের পত্রিকার পাঠক বন্ধুর উদ্যোগে মাদক বিরোধী র‌্যালি,সেমিনার ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত নতুন ব্রিজ এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে পথচারী জমির দলিলের প্রলোভানা দিয়ে গ্রাম পুলিশের নির্দেশে সোনিয়া আক্তার নামে এক নারীকে নির্যাতন করে আমরা আর কোনো অবিচার চাই না’ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালককে বদলি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রংপুরে বিক্ষোভ রিমান্ডে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন সাবেক ২ আইজিপি বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ফের উত্তাল আশুলিয়া, বন্ধ ৫২ কারখানা ট্রাইব্যুনালে প্রথমবার হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ

ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার শিশু, আইন আছে বাস্তবায়ন নেই

শিশুরা পবিত্রতার প্রতীক, শিশুরা নিস্পাপ, কিন্তু সেই শিশু নির্যাতন বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। পরিবারিক ভাবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। পরিবারেই শিশুরা মানসিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরে-বাইরে, কাজের জায়গায় শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর উপর নিপীড়ন চালানো হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যারা পথশিশু তাদের কাছেতো নির্যাতন, লাঞ্ছনা, যৌন নিপীড়ন নিত্য দিনের সঙ্গী। পরিবারে, সমাজে, স্কুলে সর্বত্রই শিশুকে ভয় দেখানো, চুল টানা, মারধর করা, দাঁড় করিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেয়া, ছুঁড়ে ফেলা, টানা হেঁচড়া করা ইত্যাদি শাস্তি দেয়া হয় মানুষের মতো মানুষ করার জন্য!

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই বুঝতে পারে না তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বাইরের মানুষের দ্বারা নয় বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষদের দ্বারা। নির্যাতনকারীরা অনেক শিশুকে খেলার ছলে নির্যাতন করে, আর শিশুরা তখন মনে করে এটা একটা খেলা। একারণে শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। এজন্য শিশুর বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের চাওয়া-পাওয়া ও মতামেতের মূল্য দিতে হবে।

শতভাগ কর্মজীবী শিশু নির্যাতনের শিকার

নামতার আশিক(ছদ্মনাম) রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি হোটেলে কাজ করে। বয়স খুব বেশি হলে ১৩-১৪ বছর। থাকা ও খাওয়ার পাশাপাশি দিনে ১৫০ টাকা বেতন। আশিকের দেশের বাড়ী বরিশাল। এই ছোট বয়সে কেন কাজ করছে জিজ্ঞেস করলে আশিকের চোখে ভাসতে থাকে কষ্টের নোনা পানি। তাকে পাশে বসিয়ে কথা বলতে চাইলে সে ভয়ে কথা বলতে চাই না। পরেরদিন আবার দেখা হয় আশিকের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে আশিক বলে, ‘ভাইজান বাড়িতে খাবার নাই। গরিব মানুষ আমরা মা আর দুইবোন আছে বাড়িতে কাজ করে তাদরে জন্য টাকা পাঠাতে হয় কি করবো।’

কাজ করতে এসে নির্যাতনের শিকার হতে হয় কি না জানতে চাইলে আশিক বলে, ‘গালিগালাজ শুনতে শুনতে অভস্ত হয়ে গেছি। এখন আর কিছু মনে হয় না। হাত থেকে জিনিসপত্র পরে গেলে মাঝেমাঝে মারও খেতে হয়। কি করবো গালিগালাজ আর মার খেয়েও পেরে জন্য কাজ করতে হয়।’

রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের একটি বাসা থেকে ২৬ আগস্ট সকালে এক শিশু গৃহকর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নির্যাতনে নিহত আট বছর বয়সী গৃহকর্মীর নাম হেনা। ঘটনার পর থেকেই বাসার মালিক সাথি পারভীন পলাতক। পুলিশের ধারণা, শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যার পর পালিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় হত্যা মামলা করেছে।

এভাবে শুধু আশিক কিংবা হেনা নয় তাদের মত সব কর্মজীবী শিশু কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে মোট ১১টি এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ১৫ জন এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। ১৫ জন গৃহকর্মী ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত ও ৩ জন আত্মহত্যা করেছে। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ২ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

বিভিন্ন জরিপে বলছে, বাংলাদেশে ঘরে-বাইরে, স্কুলে ও কাজের ক্ষেত্রে ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার। এদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে শিশু ও ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে শিশু। আর মেয়েশিশুরা ঘরেই যৌন নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছে। তথ্য সূত্র (আইএনসিআইডিআইএন বাংলাদেশ)।

২০২২ সালের তথ্য অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্য দুর্ঘটনা, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪২৬ জন। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ৯৪ দাড়িঁয়েছে অর্থাৎ এক বছরে ২৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে। তথ্য সূত্র (এমজেএফ) ফাউন্ডেশন।

২০২২ এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬০ জন শিশু এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৮ জন শিশুকে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১২টি মেয়েশিশু। ২০২১ সালে শিশুধর্ষণের এই সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখের মত শিশু রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এদের মধ্যে বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিশু। ৯০ শতাংশ হারে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন নির্যাতনের শিকার এবং প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ জন শিশু। তথ্য সূত্র ( ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ২০২২)।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, সারাদেশে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে এক হাজার ৫২৬ জন হত্যার শিকার, এক হাজার ৪৭৫ শিশু নিপীড়নের শিকার । ২০১৭ সালে শিশুহত্যা ৩৩৯ জন। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় ৯০১ শিশু।

অভিভাবকদের দ্বারা বাড়িতে চলে শিশু নির্যাতন

শাজাহানপুর রেলওয়ে কোলনিতে মায়ের সাথে থাকে ১০ বছর বয়সী লাবিবা। বাবা অসুস্থ থাকায় কোন কাজ করতে পারে না। তার মা মতিঝিলের একটা অফিসে পরিস্কার আয়ার কাজ করে। বাসার বেশিরভাগ কাজ এই ছোট বয়সে লাবিবারই করা লাগে। তবে কাজে ভুল হলে বা খেলার জন্য কাজ না করলে তার মা বাড়িতে এসে তাকে অনেক মারে।

আসা যাক ৮ বছরের শিশু ফারাবির কথায়। বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। বাড়িতে দুইজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকে না। ফারাবি একটি বেসরকারি কিন্টার গার্ডেন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সারাদিন একা থাকতে তার ভালো লাগে না। পড়াশোনায় ‘অমনোযোগী’ হয়ে পরছে দিনদিন কোন কথা শুনতে চাই না। তাই তার বাবা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার ফলে তার হাতের আঙ্গুল ভেঙে গিয়েছে। কারণে এখন তাকে নিয়ে খিদমাহ হাসপাতালে তার বাবা-মা।

বাংলাদেশে লাবিবা-ফারাবির মতো ঘরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ৯৫ দশমিক ৮ জন শিশু। পরিবারিক ভাবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা।

পড়াশোনার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে শিশু নির্যাতন

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭০ ধারায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় করা একটি মামলায় দেখা যায়। অত্রএলাকায় কাশেমিয়া হাফেজিয়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও এতিখানা রয়েছে। সেখানে পড়াশোনা করে ইয়াসিন নামে ৯ বছরের এক ছাত্র। তাকে মারপিট করে জখম করার দায়ে শিশুটির মা মসজিদ ও এতিখানার ইমারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ মে সকালে ইয়াসিনকে বাসায় রেখে তার মা কাজে গিয়েছিলেন। এসময় এতিমখানার ইমাম আরিফ বিল্লাহ খান তাদের বাড়িতে এসে ইয়াছিনকে মারতে মারতে মাদরাসায় নিয়ে যায়। ইয়াছিনের মা কাজ থেকে ফিরে এতিমখানায় গিয়ে দেখেন তার ছেলেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তার সারা শরীরে নীলাফোলা রক্ত জমাটসহ জখম করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার পর ইমাম আরিফকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে হোসেনাবাদ ফজলুল হক উলুম বহুমুখী মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র আবু (ছদ্মনাম)। মাদ্রাসার শিক্ষক সিরাজুল হক রাত রাত ১২টার দিকে  নিজ কক্ষে ডেকে নেয় তাকে। এসময় তাকে জোরপূর্বক বলাৎকার করে ঘটনাটি কাউকে না বলার জন্য হুমকি দেয় ওই শিক্ষক। পরে সকালে বলাৎকারের শিকার ওই শিশু তার পিতাকে ঘটনাটি জানাই। তার পিতা দৌলতপুর থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ মাদ্রাসা থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকে আটক করে।

এছাড়াও স্কুলে, মাদরাসায়, এতিমখানায় শিশু বলৎকারের মত ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অথচ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা পতিষ্ঠানের শিশু নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতকারীর নামে মামলা করা হচ্ছে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে কিন্তু থামছে না শিশু নির্যাতন। ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে  পরিপত্র জারি হওয়ার পরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন। ইয়াসিনের মতো অনেক অবুঝ শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধেও করা হচ্ছে মামলা। তারপরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু নির্যাতন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘নির্যাতনের ফলে শিশুটির ভবিষ্যৎ জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ জনবাণীকে বলেন, নির্যাতনে মানসিকভাবে শিশুরা বিপর্যস্ত হয়। পারিবারিক সহিংসতার শিক্ষা হচ্ছে শিশুর গায়ে হাত তোলা বা শিশুর মনটা ছোট করে দেওয়া। অনেক সময় তারা জায়গামতো কথা বলতে পারে না, তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জনবাণীকে বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুদের প্রতি নির্যাতন হয়। এছাড়া তাদের নানা কথা আমরা শুনি না, শিশু বলে অবহেলা করি। এটাও এক ধরনের নির্যাতন। অনেক সময় আমরা আমাদের নানান রাগ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেই। শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেওয়া হয় না। অনেক সময় বাবা-মা বাচ্চাদের শাসন করলেও তারা সেটাকে নির্যাতন মনে করে না। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের মতামত প্রাধান্য দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ এম কে তালুকদার জনবাণীকে বলেন, ‘শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা কোনভাবেই ঠিক না। মানসিক আঘাত করলে শিশু নানা অপরাধ-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তাই নিজের সন্তানই হোক বা পরের সন্তান হোক, শিশুদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা ঠিক না। এতে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাঘাত ঘটে।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু জনবাণীকে বলেন, ‘যারা শিশুদের নির্যাতন করে বা শ্রম করায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে, কিন্তু এ আইনের প্রয়োগটা অনেক কম। আইন করার পরও যদি তা প্রয়োগ না করা হয় তাহলে আইনের কোনো মূল্যায়ন থাকে না। শাস্তি নিশ্চিত করা হলে শিশু নির্যাতন ও শিশু শ্রম অনেকটা কমে আসবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার রিংকি জনবাণীকে বলেন, শিশুশ্রম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধের আইন থাকলেও কিছুতেই এগুলো থামছে না। যেসকল লোক এ ধরনের কাজ করছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। নির্যাতনের কারণে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরা আমাদের দেশের সম্পদ। এ সম্পদ যেন অবহেলার শিকার হয়ে ঝরে না পরে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খালিদ হোসেন জনবাণীকে বলেন, বাংলাদেশের আইনে শিশু নির্যাতন ও শ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও গ্রাম ও শহরে সমানতালে বেড়েই চলেছে। সরকার নানানভাবে শিশু নির্যাতন ও শ্রম বন্ধের চেষ্টা করলেও তা যথাযথ সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে, কাজের জায়গায় শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়। আর্থিক সংকটের কারণে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং যারা শিশুদের কাজে নিচ্ছে অল্প খরচে তাদেরকে কাজে খাটাতে পারছে। আমাদের দেশে তো অনেক আইনই আছে, বাস্তবায়ন কয়টা হয়। আইন থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না।’

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

দাউদকান্দি উপজেলা নবাগত ইউএন ও এসিল্যান্ড ভূমি ও পৌর প্রশাসক মো: জিয়াউর রহমান কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময়

ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার শিশু, আইন আছে বাস্তবায়ন নেই

আপডেট সময় ০১:৩৬:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শিশুরা পবিত্রতার প্রতীক, শিশুরা নিস্পাপ, কিন্তু সেই শিশু নির্যাতন বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। পরিবারিক ভাবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। পরিবারেই শিশুরা মানসিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরে-বাইরে, কাজের জায়গায় শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর উপর নিপীড়ন চালানো হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যারা পথশিশু তাদের কাছেতো নির্যাতন, লাঞ্ছনা, যৌন নিপীড়ন নিত্য দিনের সঙ্গী। পরিবারে, সমাজে, স্কুলে সর্বত্রই শিশুকে ভয় দেখানো, চুল টানা, মারধর করা, দাঁড় করিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেয়া, ছুঁড়ে ফেলা, টানা হেঁচড়া করা ইত্যাদি শাস্তি দেয়া হয় মানুষের মতো মানুষ করার জন্য!

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই বুঝতে পারে না তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বাইরের মানুষের দ্বারা নয় বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষদের দ্বারা। নির্যাতনকারীরা অনেক শিশুকে খেলার ছলে নির্যাতন করে, আর শিশুরা তখন মনে করে এটা একটা খেলা। একারণে শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। এজন্য শিশুর বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের চাওয়া-পাওয়া ও মতামেতের মূল্য দিতে হবে।

শতভাগ কর্মজীবী শিশু নির্যাতনের শিকার

নামতার আশিক(ছদ্মনাম) রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি হোটেলে কাজ করে। বয়স খুব বেশি হলে ১৩-১৪ বছর। থাকা ও খাওয়ার পাশাপাশি দিনে ১৫০ টাকা বেতন। আশিকের দেশের বাড়ী বরিশাল। এই ছোট বয়সে কেন কাজ করছে জিজ্ঞেস করলে আশিকের চোখে ভাসতে থাকে কষ্টের নোনা পানি। তাকে পাশে বসিয়ে কথা বলতে চাইলে সে ভয়ে কথা বলতে চাই না। পরেরদিন আবার দেখা হয় আশিকের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে আশিক বলে, ‘ভাইজান বাড়িতে খাবার নাই। গরিব মানুষ আমরা মা আর দুইবোন আছে বাড়িতে কাজ করে তাদরে জন্য টাকা পাঠাতে হয় কি করবো।’

কাজ করতে এসে নির্যাতনের শিকার হতে হয় কি না জানতে চাইলে আশিক বলে, ‘গালিগালাজ শুনতে শুনতে অভস্ত হয়ে গেছি। এখন আর কিছু মনে হয় না। হাত থেকে জিনিসপত্র পরে গেলে মাঝেমাঝে মারও খেতে হয়। কি করবো গালিগালাজ আর মার খেয়েও পেরে জন্য কাজ করতে হয়।’

রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের একটি বাসা থেকে ২৬ আগস্ট সকালে এক শিশু গৃহকর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নির্যাতনে নিহত আট বছর বয়সী গৃহকর্মীর নাম হেনা। ঘটনার পর থেকেই বাসার মালিক সাথি পারভীন পলাতক। পুলিশের ধারণা, শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যার পর পালিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় হত্যা মামলা করেছে।

এভাবে শুধু আশিক কিংবা হেনা নয় তাদের মত সব কর্মজীবী শিশু কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে মোট ১১টি এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ১৫ জন এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। ১৫ জন গৃহকর্মী ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত ও ৩ জন আত্মহত্যা করেছে। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ২ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

বিভিন্ন জরিপে বলছে, বাংলাদেশে ঘরে-বাইরে, স্কুলে ও কাজের ক্ষেত্রে ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার। এদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে শিশু ও ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে শিশু। আর মেয়েশিশুরা ঘরেই যৌন নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছে। তথ্য সূত্র (আইএনসিআইডিআইএন বাংলাদেশ)।

২০২২ সালের তথ্য অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্য দুর্ঘটনা, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪২৬ জন। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ৯৪ দাড়িঁয়েছে অর্থাৎ এক বছরে ২৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে। তথ্য সূত্র (এমজেএফ) ফাউন্ডেশন।

২০২২ এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬০ জন শিশু এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৮ জন শিশুকে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১২টি মেয়েশিশু। ২০২১ সালে শিশুধর্ষণের এই সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখের মত শিশু রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এদের মধ্যে বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিশু। ৯০ শতাংশ হারে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন নির্যাতনের শিকার এবং প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ জন শিশু। তথ্য সূত্র ( ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ২০২২)।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, সারাদেশে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে এক হাজার ৫২৬ জন হত্যার শিকার, এক হাজার ৪৭৫ শিশু নিপীড়নের শিকার । ২০১৭ সালে শিশুহত্যা ৩৩৯ জন। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় ৯০১ শিশু।

অভিভাবকদের দ্বারা বাড়িতে চলে শিশু নির্যাতন

শাজাহানপুর রেলওয়ে কোলনিতে মায়ের সাথে থাকে ১০ বছর বয়সী লাবিবা। বাবা অসুস্থ থাকায় কোন কাজ করতে পারে না। তার মা মতিঝিলের একটা অফিসে পরিস্কার আয়ার কাজ করে। বাসার বেশিরভাগ কাজ এই ছোট বয়সে লাবিবারই করা লাগে। তবে কাজে ভুল হলে বা খেলার জন্য কাজ না করলে তার মা বাড়িতে এসে তাকে অনেক মারে।

আসা যাক ৮ বছরের শিশু ফারাবির কথায়। বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। বাড়িতে দুইজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকে না। ফারাবি একটি বেসরকারি কিন্টার গার্ডেন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সারাদিন একা থাকতে তার ভালো লাগে না। পড়াশোনায় ‘অমনোযোগী’ হয়ে পরছে দিনদিন কোন কথা শুনতে চাই না। তাই তার বাবা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার ফলে তার হাতের আঙ্গুল ভেঙে গিয়েছে। কারণে এখন তাকে নিয়ে খিদমাহ হাসপাতালে তার বাবা-মা।

বাংলাদেশে লাবিবা-ফারাবির মতো ঘরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ৯৫ দশমিক ৮ জন শিশু। পরিবারিক ভাবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা।

পড়াশোনার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে শিশু নির্যাতন

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭০ ধারায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় করা একটি মামলায় দেখা যায়। অত্রএলাকায় কাশেমিয়া হাফেজিয়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও এতিখানা রয়েছে। সেখানে পড়াশোনা করে ইয়াসিন নামে ৯ বছরের এক ছাত্র। তাকে মারপিট করে জখম করার দায়ে শিশুটির মা মসজিদ ও এতিখানার ইমারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ মে সকালে ইয়াসিনকে বাসায় রেখে তার মা কাজে গিয়েছিলেন। এসময় এতিমখানার ইমাম আরিফ বিল্লাহ খান তাদের বাড়িতে এসে ইয়াছিনকে মারতে মারতে মাদরাসায় নিয়ে যায়। ইয়াছিনের মা কাজ থেকে ফিরে এতিমখানায় গিয়ে দেখেন তার ছেলেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তার সারা শরীরে নীলাফোলা রক্ত জমাটসহ জখম করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার পর ইমাম আরিফকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে হোসেনাবাদ ফজলুল হক উলুম বহুমুখী মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র আবু (ছদ্মনাম)। মাদ্রাসার শিক্ষক সিরাজুল হক রাত রাত ১২টার দিকে  নিজ কক্ষে ডেকে নেয় তাকে। এসময় তাকে জোরপূর্বক বলাৎকার করে ঘটনাটি কাউকে না বলার জন্য হুমকি দেয় ওই শিক্ষক। পরে সকালে বলাৎকারের শিকার ওই শিশু তার পিতাকে ঘটনাটি জানাই। তার পিতা দৌলতপুর থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ মাদ্রাসা থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকে আটক করে।

এছাড়াও স্কুলে, মাদরাসায়, এতিমখানায় শিশু বলৎকারের মত ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অথচ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা পতিষ্ঠানের শিশু নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতকারীর নামে মামলা করা হচ্ছে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে কিন্তু থামছে না শিশু নির্যাতন। ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে  পরিপত্র জারি হওয়ার পরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন। ইয়াসিনের মতো অনেক অবুঝ শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধেও করা হচ্ছে মামলা। তারপরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু নির্যাতন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘নির্যাতনের ফলে শিশুটির ভবিষ্যৎ জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ জনবাণীকে বলেন, নির্যাতনে মানসিকভাবে শিশুরা বিপর্যস্ত হয়। পারিবারিক সহিংসতার শিক্ষা হচ্ছে শিশুর গায়ে হাত তোলা বা শিশুর মনটা ছোট করে দেওয়া। অনেক সময় তারা জায়গামতো কথা বলতে পারে না, তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জনবাণীকে বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুদের প্রতি নির্যাতন হয়। এছাড়া তাদের নানা কথা আমরা শুনি না, শিশু বলে অবহেলা করি। এটাও এক ধরনের নির্যাতন। অনেক সময় আমরা আমাদের নানান রাগ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেই। শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেওয়া হয় না। অনেক সময় বাবা-মা বাচ্চাদের শাসন করলেও তারা সেটাকে নির্যাতন মনে করে না। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের মতামত প্রাধান্য দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ এম কে তালুকদার জনবাণীকে বলেন, ‘শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা কোনভাবেই ঠিক না। মানসিক আঘাত করলে শিশু নানা অপরাধ-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তাই নিজের সন্তানই হোক বা পরের সন্তান হোক, শিশুদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা ঠিক না। এতে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাঘাত ঘটে।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু জনবাণীকে বলেন, ‘যারা শিশুদের নির্যাতন করে বা শ্রম করায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে, কিন্তু এ আইনের প্রয়োগটা অনেক কম। আইন করার পরও যদি তা প্রয়োগ না করা হয় তাহলে আইনের কোনো মূল্যায়ন থাকে না। শাস্তি নিশ্চিত করা হলে শিশু নির্যাতন ও শিশু শ্রম অনেকটা কমে আসবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার রিংকি জনবাণীকে বলেন, শিশুশ্রম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধের আইন থাকলেও কিছুতেই এগুলো থামছে না। যেসকল লোক এ ধরনের কাজ করছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। নির্যাতনের কারণে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরা আমাদের দেশের সম্পদ। এ সম্পদ যেন অবহেলার শিকার হয়ে ঝরে না পরে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খালিদ হোসেন জনবাণীকে বলেন, বাংলাদেশের আইনে শিশু নির্যাতন ও শ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও গ্রাম ও শহরে সমানতালে বেড়েই চলেছে। সরকার নানানভাবে শিশু নির্যাতন ও শ্রম বন্ধের চেষ্টা করলেও তা যথাযথ সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে, কাজের জায়গায় শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়। আর্থিক সংকটের কারণে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং যারা শিশুদের কাজে নিচ্ছে অল্প খরচে তাদেরকে কাজে খাটাতে পারছে। আমাদের দেশে তো অনেক আইনই আছে, বাস্তবায়ন কয়টা হয়। আইন থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না।’