উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ। নানা সংগ্রাম ও চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে সময়ের স্রোতে পার করছে ১৫১ বছর। দেশসেরা এ প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া কলেজের ঝুঁলিতে অপ্রাপ্তির তুলনায় প্রাপ্তির সংখ্যা ঢের বেশি।
ভাষা আন্দোলন কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধই শুধু নয়, প্রতিটি জাতীয় ও ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহী কলেজের অবদান অপরিসীম। জাতির প্রয়োজনে প্রতিটি গণআন্দোলনে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মরণীয় ভূমিকা পালন নজির স্থাপন করেছে।
উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সফল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরন্তর অবদানে সগৌরবে সমুজ্জ্বল রাজশাহী কলেজ।
খরস্রোতা পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। মাত্র ৫ জন হিন্দু ও একজন মুসলিম ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ পরিণত হয়েছে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে।
প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত উত্তরবঙ্গ তথা দেশের শিক্ষাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলা প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে টানা চার বারের সেরা কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ জমিদার রাজার হাতে জন্ম নেওয়া কলেজে যুগে যুগে অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এসেছেন জ্ঞানার্জনে, নিজেকে গড়েছেন, আবার কালের পরিক্রমায় আলো বিলিয়ে চলে গেছেন পরপারে। সেই আলোতে আজও পথ চলে নতুন প্রজন্ম।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩১টি সূচকে টানা চারবার এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি সূচকে প্রতিবারই সেরার মুকুট অর্জন করেছে রাজশাহী কলেজ। মডেল কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে রাজশাহী কলেজের ঝুঁলিতেই।
তথ্যমতে, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও রাজশাহী জেলা স্কুলের (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) হাত ধরেই পথচলা শুরু রাজশাহী কলেজের। ১৮৭২ সালে দুবলহাটির রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর দানকৃত সম্পত্তি ও দীঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায়ের এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় স্থাপিত হয় ভবন।
১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী জেলা স্কুলে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণী চালুর মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় প্রথম গ্রেডের মর্যাদা পায় কলেজটি।
ছাত্রসংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় একশতে, রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় সে সময়েই। একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে রাজশাহী কলেজেই চালু হয় বিএ কোর্স।
কলেজে ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স চালু হয়। স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি মিলে ১৮৭৭ সালের অক্টোবরে। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয় কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন)।
১৯০২ সালে পুঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে।
এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রমও। তবে শিক্ষার্থী নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল কার্যক্রমটি।
তৎকালীন রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। সুদীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য প্রথিতযশা ব্যক্তি শিক্ষকতা করেছেন কলেজটিতে।
তাঁদের মধ্যে এফ টি ডাউডিং, শ্রী কুমার ব্যানার্জী, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. শামস উল হক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কথিত আছে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো।
সে সময় অভিবক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে অগণিত শিক্ষার্থী আসতো জ্ঞানার্জনের জন্য। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত ভারতবর্ষে রাজশাহীর পরিচয়ই ছিল রাজশাহী কলেজের নামে।
চীনা কারিগর মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশশৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এই কলেজের প্রশাসন ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে সগৌরবে।
হাজি মুহাম্মদ মহসীন ভবন, ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবনের মত লালরঙ্গা ভবনগুলো এখনও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। ভবনগুলো আজও সেই আমলের রাজকীয় স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয় বর্তমান প্রজন্মকে।
কলেজের এই সুরম্য স্থাপত্যশৈলী এখনো সগৌরবে কলেজটির ঐতিহাসিক পরিচয় ঘোষণা করে। ফলে রাজশাহী কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে লালরঙা ভবন, যা যে কোনো পথচারীর মনোযোগ কাড়ে নীরবে।
রাজশাহী কলেজ মানেই লাল ভবন ও সবুজ প্রকৃতিতে ঘেলা একটি সুন্দর ও পরিপাটি ক্যাম্পাস। পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, আড্ডা, গল্প কিংবা গান সব কিছুই চলে সমান তালে।
শুধু জ্ঞানার্জনই নয়, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুথান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বাঙালীর সকল গৌরবোজ্জল ইতিহাসে আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে রয়েছে রাজশাহী কলেজের নাম।
৫২’র ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী সব শহীদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনারও রয়েছে এই ক্যাম্পাসেই। ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলি বর্ষণের খবর ট্রেনে করে রাজশাহী আসে।
তাৎক্ষনিক রাজশাহী কলেজ ও আশপাশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার শিক্ষার্থীরা সমবেত হয় কলেজ ছাত্রাবাসে। সিদ্ধান্ত হয় ইট-মাটি দিয়ে রাতেই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি।