ঢাকা ০২:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়ার দাবি

 বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের একমাত্র নারী কমান্ডার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশের টানে যুদ্ধে চলে যান আশালতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। এ ছাড়া ৩৫০ জন নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। অথচ স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরেই আমরা ভুলে গেছি তাকে, ভুলে গেছে তার অবদানের কথা। আশালতা বৈদ্য ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবনেই দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব সেক্টরের হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন। হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা বাহিনী নামে আলাদা একটা বাহিনী গঠন করা হয়। এ মহিলা বাহিনীতে মোট ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিশাল নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। ২২টি বড় বড় যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ছিলেন সাড়ে তিন শত নারী মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা তাদের বাড়িতে এসে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে কয়েক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আশালতা ও তার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় হরিপদ বাবু মেয়েদের রক্ষায় সপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন। এই ঘটনার আদ্যপ্রান্ত কানে যায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের। তিনি আশালতাকে দেশত্যাগ না করে দেশ রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন। আশালতা বৈদ্য সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নিজ এলাকার সাহসী ৪৫ মেয়েকেও আশালতা উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের নিয়ে গঠন করেন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা দল। মে মাসে এ দল পুরোপুরি সংগঠিত হলে তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুর বাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। প্রশিক্ষণ হয় রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড চার্জসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের উপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন। যে কারণে আরো ৩০০ জন মেয়েসহ মোট ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাকে। বিশাল এই নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব পেয়ে আশালতা বৈদ্য দায়িত্ব পালনে দুঃসাহসিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এবার যুদ্ধে গেরিলা অপারেশন শুরু হওয়ার পালা। ১৯৭১ এর ২৪ জুন কোটালীপাড়া, হরিণাহাটি, ঘাঘর বাজার, শিকের বাজার ও রামশীলে খান সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই বীর নারী। এই যুদ্ধে আশালতা বৈদ্যের দুঃসাহসিকতা, সুনিপুণতা, দক্ষতা রূপকথাকেও হার মানায়। সে দিন তার বাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং বন্দি হয় ২৫ পাকিস্তানি সেনা। বন্দি পাকিস্তানী সেনাদের ধরে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে তাদের বিচার করা হয়। বিচারকদের একজন ছিলেন আশলতা বৈদ্য স্বয়ং। বিচারে তাদের সবাইকে হত্যার রায় হয়। আশালতার নির্দেশে সে রায় কার্যকর করা হয়। সকল বন্দী পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্যের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি জানতে পারলেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা তাদের নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বন্দি হয়ে আছেন। এই ঘটনা জানতে পেরে আশালতা বৈদ্য নিজেই এক দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। পরে তাদের নিয়ে যান শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নিজ উদ্যোগেই সেখানে তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায়, রামশীল নদী পাড়ে একদিন রাজাকাররা লঞ্চে করে কয়েক হাজার পাকিস্তানি সেনাকে সাথে নিয়ে আসে। সেখানে পাকসেনাদের সঙ্গে আশালতা বৈদ্য এবং তার সহযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধ ৩ ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকার নিহত হয় মাত্র কয়েক’শ মুক্তিযোদ্ধার হাতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর ৯টি মাসের ১টি দিনও তার যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের পরিকল্পনা ছাড়া কাটেনি। এই ৯ মাস দেশের জন্য যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় ক্ষণিকের জন্যও আসে নি। মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দিয়ে ৮ এবং ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে গোপালগঞ্জে ছোটোখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেন। অনেক পাকিস্তানি সেনাকে নিজ হাতে হত্যাও করেন। তিনি শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজে। সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সহযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলে তাদের সঙ্গে নিয়ে আবার যুদ্ধে গেছেন। এই অপ্রতিরোধ্য নারী যোদ্ধা যুদ্ধকেই যেন ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার পর তাদের টিম সবচেয়ে বেশি করেছে পুনর্বাসনের কাজ। শরণার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে যোগদানের পর তিনি বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও ‘বঙ্গবন্ধু’কে হত্যার সময়টা দুর্বিসহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় সে সময়ে তাকে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে অসংখ্য মামলায় আসামি করা হয়। পরে রোকেয়া হল থেকে তৎকালীন সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। ঐ সময় সামরিক বাহিনীর হাতে আশালতা বৈদ্য ও তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সময় সামরিক বাহিনীর হাতে আশালতা বৈদ্য ও তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার পড়াশুনা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। গত শতকের ৮০’র দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী সংস্থা’। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বার বার। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ নারী সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্নপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত অবদানের পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আজও কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পাননি। প্রজন্মও মনে রাখে নি বাংলা মায়ের এই বীরকন্যা আশালতা বৈদ্যকে। এখন সারাদেশে দাবী উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সাহসী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দিতে। বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই দাবীকে আলোর মুখ দেখতে পারেন এবং দেশের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে মূল্যায়ন করতে পারেন।
Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়ার দাবি

আপডেট সময় ০২:৪২:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩
 বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের একমাত্র নারী কমান্ডার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশের টানে যুদ্ধে চলে যান আশালতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। এ ছাড়া ৩৫০ জন নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। অথচ স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরেই আমরা ভুলে গেছি তাকে, ভুলে গেছে তার অবদানের কথা। আশালতা বৈদ্য ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবনেই দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব সেক্টরের হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন। হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা বাহিনী নামে আলাদা একটা বাহিনী গঠন করা হয়। এ মহিলা বাহিনীতে মোট ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিশাল নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। ২২টি বড় বড় যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ছিলেন সাড়ে তিন শত নারী মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা তাদের বাড়িতে এসে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে কয়েক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আশালতা ও তার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় হরিপদ বাবু মেয়েদের রক্ষায় সপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন। এই ঘটনার আদ্যপ্রান্ত কানে যায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের। তিনি আশালতাকে দেশত্যাগ না করে দেশ রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন। আশালতা বৈদ্য সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নিজ এলাকার সাহসী ৪৫ মেয়েকেও আশালতা উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের নিয়ে গঠন করেন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা দল। মে মাসে এ দল পুরোপুরি সংগঠিত হলে তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুর বাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। প্রশিক্ষণ হয় রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড চার্জসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের উপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন। যে কারণে আরো ৩০০ জন মেয়েসহ মোট ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাকে। বিশাল এই নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব পেয়ে আশালতা বৈদ্য দায়িত্ব পালনে দুঃসাহসিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এবার যুদ্ধে গেরিলা অপারেশন শুরু হওয়ার পালা। ১৯৭১ এর ২৪ জুন কোটালীপাড়া, হরিণাহাটি, ঘাঘর বাজার, শিকের বাজার ও রামশীলে খান সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই বীর নারী। এই যুদ্ধে আশালতা বৈদ্যের দুঃসাহসিকতা, সুনিপুণতা, দক্ষতা রূপকথাকেও হার মানায়। সে দিন তার বাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং বন্দি হয় ২৫ পাকিস্তানি সেনা। বন্দি পাকিস্তানী সেনাদের ধরে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে তাদের বিচার করা হয়। বিচারকদের একজন ছিলেন আশলতা বৈদ্য স্বয়ং। বিচারে তাদের সবাইকে হত্যার রায় হয়। আশালতার নির্দেশে সে রায় কার্যকর করা হয়। সকল বন্দী পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্যের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি জানতে পারলেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা তাদের নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বন্দি হয়ে আছেন। এই ঘটনা জানতে পেরে আশালতা বৈদ্য নিজেই এক দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। পরে তাদের নিয়ে যান শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নিজ উদ্যোগেই সেখানে তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায়, রামশীল নদী পাড়ে একদিন রাজাকাররা লঞ্চে করে কয়েক হাজার পাকিস্তানি সেনাকে সাথে নিয়ে আসে। সেখানে পাকসেনাদের সঙ্গে আশালতা বৈদ্য এবং তার সহযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধ ৩ ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকার নিহত হয় মাত্র কয়েক’শ মুক্তিযোদ্ধার হাতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর ৯টি মাসের ১টি দিনও তার যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের পরিকল্পনা ছাড়া কাটেনি। এই ৯ মাস দেশের জন্য যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় ক্ষণিকের জন্যও আসে নি। মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দিয়ে ৮ এবং ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে গোপালগঞ্জে ছোটোখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেন। অনেক পাকিস্তানি সেনাকে নিজ হাতে হত্যাও করেন। তিনি শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজে। সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সহযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলে তাদের সঙ্গে নিয়ে আবার যুদ্ধে গেছেন। এই অপ্রতিরোধ্য নারী যোদ্ধা যুদ্ধকেই যেন ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার পর তাদের টিম সবচেয়ে বেশি করেছে পুনর্বাসনের কাজ। শরণার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে যোগদানের পর তিনি বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও ‘বঙ্গবন্ধু’কে হত্যার সময়টা দুর্বিসহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় সে সময়ে তাকে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে অসংখ্য মামলায় আসামি করা হয়। পরে রোকেয়া হল থেকে তৎকালীন সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। ঐ সময় সামরিক বাহিনীর হাতে আশালতা বৈদ্য ও তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সময় সামরিক বাহিনীর হাতে আশালতা বৈদ্য ও তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার পড়াশুনা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। গত শতকের ৮০’র দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী সংস্থা’। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বার বার। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ নারী সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্নপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত অবদানের পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আজও কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পাননি। প্রজন্মও মনে রাখে নি বাংলা মায়ের এই বীরকন্যা আশালতা বৈদ্যকে। এখন সারাদেশে দাবী উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সাহসী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দিতে। বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই দাবীকে আলোর মুখ দেখতে পারেন এবং দেশের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে মূল্যায়ন করতে পারেন।