জাহেলিয়াতের কালো মেঘে আচ্ছন্ন করে রাখা আরব উপকূলে সৌভাগ্যরবি উদিত হয় হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে। অন্ধকার যুগও সোনালি যুগে পরিনত হয় নববী আদর্শে। শুধু আরববাসীর জন্য নয় তিনি ছিলেন গোটা জগতবাসীর জন্য আলোকবর্তিকা। শৈশব থেকে কৈশোর, বালক থেকে যুবক জীবনের যে কোনো মঞ্জিলে তিনি হলেন সর্বোত্তম আদর্শের ধারক। শুধু নবুওয়তি জীবনই নয়, নবুওয়তপূর্ব জীবনেও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আদর্শের যে দৃষ্টান্ত ও নমুনা স্থাপন করেছেন; তা পৃথিবীর অনাদিকালের মানুষের জন্য, সত্যাশ্রয়ী হৃদয়ে অদ্বিতীয় আলোর উৎস হয়ে আছে চিরকালের জন্য।
মহানবী সা: এর জন্মের আগে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল; যা দ্বারা বিশ্ববাসী বুঝতে পারে যে, পৃথিবীতে এমন এক মহামানব আবির্ভাব হতে যাচ্ছেন, যিনি হবেন অনুপম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী ও আলোর দিশারী। যেমন মা আমিনা বলেছেন, যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন দেহ থেকে একটি নূর বের হলো। সেই নূর দ্বারা শাম দেশের মহল উজ্জ্বল হয়ে গেল। অনেক কিতাবে আরও লেখা হয়েছে, কেসরার রাজপ্রাসাদের চৌদ্দটি পিলার ধসে পড়েছিল। অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছিল। বহিরার গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
মা হালিমা বলেন, আমি শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার ঘরে আনার পর সব অভাব মোচন হয়ে যায়। তাকে আনার পর আমার উভয় স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। উটনির স্তনগুলো দুধে ভরে গেল। আমাদের গাধা (বাহন)টি দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে গেল। বকরিগুলো চারণভূমি থেকে ভরা পেটে ও ভরা স্তনে ফিরে আসত। এভাবেই শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহিমা এক এক করে প্রকাশ হতে থাকে।
শিশু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হালিমার স্তন্য পান করতেন, তখন মাত্র একটি স্তন্যই পান করতেন। অপর স্তনটি তার দুধভাই হালিমার আপন শিশুপুত্রের জন্য রেখে দিতেন। অবুঝ শিশুর অধিকার প্রদানের এমন কাহিনী পৃথিবীতে বিরল। শিশু মুহাম্মদ প্রথম কথা শুরু করেছিলেন এ বাক্যটি দিয়ে, ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা- ওয়া সুবহানাল্লাহু কাসিরা। ’ অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ বড়, আর সর্বাধিক পবিত্রতা আল্লাহর জন্য।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশব থেকেই অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। তার লজ্জাশীলতা সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, কাবাঘর নির্মাণের সময় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হজরত আব্বাস রাজিয়াল্লাহু আনহু পাথর ভাঙছিলেন। কাজের এক পর্যায়ে হজরত আব্বাস রাজিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহকে বললেন, তহবন্দ(লুঙ্গি) খুলে কাঁধে বাঁধো, ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং আকাশের দিকে তাকালেন ও হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। খানিক পরেই হুঁশ ফিরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ। এরপর তাকে তহবন্দ পরিয়ে দেওয়া হয়।
সাদ বংশের লোকেরা সে যুগে বিশুদ্ধ প্রাঞ্জল আরবি ভাষায় কথাবার্তা বলার জন্য বিখ্যাত ছিল। সদৃশ্য-অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে শিশু মুহাম্মদের লালন-পালনের ভার গিয়ে পড়ল এ মার্জিত রুচি ও উন্নতমনা সাদ বংশের ওপরে। যার কারণে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই কথাবার্তায় মিষ্ট ও লালিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন।
শিশুকালেই আরবের লোকেরা তার মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করা শুরু করে। আরবে দুর্ভিক্ষ চলছিল অনাবৃষ্টির কারণে। কোরায়েশরা বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে আবু তালেবের কাছে আবেদন জানাল। আবু তালেব একটি বালক সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এবং কাবার ঘরের সামনে গিয়ে দোয়া দিলেন। বালক তার হাতে আঙ্গুল রাখলে সঙ্গে সঙ্গে আকাশে মেঘ এলো ও মুষলধারে বৃষ্টি হলো। সজীব উর্বর হয়ে গেল জমিন। আর সেই শিশুই ছিলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
শৈশব কাল থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুদরতি ভাবে গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এক হাদিসে পাওযা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করত, দুবারের বেশি কখনোই সেসব কাজ করার ইচ্ছা আমার হয়নি। সে দুটি কাজেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর সে ধরনের কাজের ইচ্ছা কখনো আমার জাগেনি।’ তা হলো তিনি বকরি ও উট চরানোর সময় দুই দিন তিনি সঙ্গের বালকের কাছে পশু রেখে মক্কা নগরীতে হওয়া রাতের আড্ডায় অংশ নিতে আসেন। সেখানে গান-বাজনা হচ্ছিল। দুই দিনই আল্লাহ তাঁর কান বন্ধ করে দেন এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।
শৈশব কাল থেকেই নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিপালন বিশেষ নিরাপদ ও কালিমামুক্ত পরিবেশে হয় এবং জাহিলিয়াতের নাপাক ও খারাপ অভ্যাসগুলো থেকে আল্লাহ তাঁকে সর্বদাই দূরে ও মুক্ত রাখেন। যাঁকে তার জাতিগোষ্ঠী প্রথম থেকেই সব চেয়ে বেশি প্রশংসনীয় গুণাবলি, উন্নত মনোবল, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, লাজনম্র, সত্যবাদী, আমানতদার, কটূক্তি ও অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ থেকে দূরে বলে মনে করত। এমনকি তাঁর জাতির লোকেরা তাঁকে আমিন (বিশ্বস্ত) নামে স্মরণ করত। মানবতার নবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম জীবন আদর্শ।
–
মুহাম্মাদ মাহদী হাসান
তরুণ আলেম, লেখক ও সাংবাদিক