সুখী সংসার গঠনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই বিশেষ করণীয় আছে। কিন্তু পরিবারের দায়িত্বশীল হিসেবে এ ক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব বেশি। একটি সুখী পরিবার গড়তে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো—
উত্তম ব্যবহার করা
উত্তম ব্যবহার দিয়ে অন্যকে জয় করা যায়, তার হৃদয়ে আসন করে নেওয়া যায়। এমনকি শত্রুকেও বশে আনা যায়। তাই স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতে হবে। কেননা সে তার স্বজন ছেড়ে শুধু স্বামীর কাছে আসে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করো। যদি তোমরা তাদের অপছন্দ করো, (তবে হতে পারে) তোমরা এমন বস্তুকে অপছন্দ করছ, যার মধ্যে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন। ’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯)
স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বসা ও খোশগল্প করা
অবসরে স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বসে কিছু গল্পগুজব করা, তার মনের কথা জানা-বোঝা, তার কোনো চাহিদা থাকলে তা জেনে নিয়ে পূরণ করা স্বামীর জন্য জরুরি। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) যখন (ফজরের সুন্নত) সালাত আদায় করতেন, তখন আমি জাগ্রত হলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন। অন্যথায় তিনি শয্যাগ্রহণ করতেন এবং ফজরের সালাতের জন্য মুয়াজ্জিন না ডাকা পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন। (বুখারি, হাদিস : ১১৬১)
স্ত্রীর জন্য সুসজ্জিত ও সুবাসিত হওয়া
স্বামীদের করণীয় হচ্ছে নিজেকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা। কেননা অপরিচ্ছন্ন থাকা ও অপরিষ্কার পোশাক পরিধান করা স্ত্রীরা পছন্দ করে না। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য সুসজ্জিত হতে এমন পছন্দ করি যেভাবে আমার জন্য তার সুসজ্জিত হওয়া পছন্দ করি। ’ (তাফসির কুরতুবি : ৫/৯৭)
বাড়িতে প্রবেশ করে স্ত্রীকে সালাম দেওয়া
সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। সে জন্য বাড়ি থেকে বের হতে ও বাড়িতে প্রবেশকালে বাড়ির অধিবাসী বিশেষত স্ত্রীকে সালাম দিতে হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মায় থাকে। যদি তারা বেঁচে থাকে তাহলে রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং তা যথেষ্ট হয়। আর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করে। যে ব্যক্তি বাড়িতে প্রবেশ করে বাড়ির লোকজনকে সালাম দেয়, সে আল্লাহর জিম্মায়। যে ব্যক্তি মসজিদের উদ্দেশে বের হয়, সে আল্লাহর জিম্মায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়, সে আল্লাহর জিম্মায়। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৯৪)
স্ত্রী অসুস্থ হলে তার সেবা করা
স্ত্রী অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত হলে সাধ্যমতো তার সেবা করা স্বামীর কর্তব্য। ইবন ওমর (রা.) বলেন, ওসমান (রা.) বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কেননা তাঁর স্ত্রী আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কন্যা অসুস্থ ছিলেন। তখন নবী করিম (সা.) তাঁকে বলেন, বদর যুদ্ধে যোগদানকারীর সমপরিমাণ সওয়াব ও (গনিমতের) অংশ তুমি পাবে। (বুখারি, হাদিস : ৩১৩০)
স্ত্রীকে সহযোগিতা করা
স্ত্রীকে পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করা স্বামীর জন্য একান্ত করণীয়। বিশেষত সে অসুস্থ হলে বা তার পক্ষে কোনো কাজ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা জরুরি। আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি পরিবারের কাজ করতেন, যখন সালাতের সময় হতো তখন তিনি সালাতের জন্য বের হয়ে যেতেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৭৬)
স্ত্রীর প্রতি উত্তম ধারণা রাখা
অনেকে স্ত্রীকে অযথা সন্দেহ করে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য ও ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাই সন্দেহ করা ঠিক নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান পাপ। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
স্ত্রীদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকরণীয়। যেমন—আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা এরূপ অপবাদ শুনলে তখন মুমিন পুরুষ ও নারীরা কেন তাদের নিজেদের মানুষদের সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করলে না?’ (সুরা : নূর, আয়াত : ১২)
স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করা
স্বামীর ওপর কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে; তোমার ওপর তোমার চোখের হক আছে এবং তোমার ওপর তোমার স্ত্রীরও হক আছে। (বুখারি, হাদিস : ১৯৭৫, ৫১৯৯)
স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা ও তাকে গুরুত্ব দেওয়া
স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাধ্যমে একটি সুখী-সুন্দর পরিবার গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে কারো অবদান কম নয়। কাউকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ স্বামী বাইরের কাজ করে আর স্ত্রী বাড়ির ভেতরের কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তাই পরিবারের যেকোনো কাজে তার সঙ্গে পরামর্শ করা ও সঠিক হলে সে পরামর্শ মূল্যায়ন করা উচিত। আল্লাহ বলেন, ‘আর জরুরি বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
রাসুল (সা.) অহি নাজিলের পরে খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে পরামর্শ করেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৯৫৩)
এবং তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে উম্মু সালামা (রা.)-এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। (বুখারি, হাদিস : ২৭৩২)
স্ত্রীকে তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া
স্ত্রীকে তার মা-বাবা, ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া উচিত। আর এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিজে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বা মাহরাম ব্যক্তিকে সঙ্গে দিয়ে পাঠাতে হবে। ইফকের ঘটনাকালে আয়েশা (রা.) অসুস্থ হলে তিনি পিতার বাড়িতে গমনের জন্য রাসুল (সা.)-এর কাছে অনুমতি চান। রাসুল (সা.) তাঁকে অনুমতি দিলে তিনি পিতৃগৃহে চলে যান। (বুখারি, হাদিস : ২৬৬১)
স্ত্রীকে দ্বিনের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া
প্রত্যেক স্বামীর জন্য কর্তব্য হলো স্ত্রীকে দ্বিনি কাজের নির্দেশ দেওয়া, যাতে তারা তা যথাসাধ্য পালন করে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি তোমার পরিবারকে সালাতের আদেশ দাও এবং তুমি এর ওপর অবিচল থাকো। ’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১৩২)
মারধর না করা
স্ত্রীকে বিনা কারণে বা তুচ্ছ কোনো ঘটনায় মারধর করা উচিত নয়। বরং তার ত্রুটি বুঝিয়ে দিয়ে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। আর মারধর করা রাসুল (সা.)-এর আদর্শ নয়। নবী করিম (সা.) কখনো তাঁর স্ত্রীদের প্রহার করেননি। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ হাতে কোনো কিছুকে প্রহার করেননি। না তাঁর কোনো স্ত্রীকে, না কোনো খাদেমকে। (মুসলিম, হাদিস : ২৩২৮)