ঢাকা ০৯:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
মিয়ানমারের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি না থাকা বড় ভুল পটুয়াখালীতে ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত শহীদ জিয়া স্মৃতি পদক পেলেন জাতীয়তাবাদী বিএনপির রাজশাহী জেলার সদস্য সচিব গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন জরুরি : যুবদল সভাপতি মোনায়েম মুন্না তাঁতীলীগের সভাপতি ইকবালের যত কান্ড, জনমনে প্রশ্ন কে এই ইকবাল? সিএমপির পাহাড়তলী থানার মাদক বিরোধী অভিযানে ভুয়া সাংবাদিক ফারুক মাদকসহ গ্রেফতার অন্তর্বতী সরকারের ১শ দিন পার হলেও সচিবালয় সহ বিভিন্ন দপ্তরের এখনও আওয়ামী লীগের দোসরা বহাল পূর্বাচলে দুর্নীতির রাজত্ব গড়েছেন নায়েব আলী শরীফ ডঃ মোশাররফ ফাউন্ডেশন কলেজ নবীনবরণ উৎসব ২০২৪ পালিত। মুগদায় ১০ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার

আলজেরীয় প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন যে হাফেজা

লালা ফাতিমা নাসুমার। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান বীরাঙ্গনা। যিনি অসীম সাহসিকতায় ফরাসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং আলজেরিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। লালা ফাতিমা নাসুমার ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম ও পীরের কন্যা।

নিজেও ছিলেন একজন হাফেজা ও আলেমা। বীরাঙ্গনা সাহাবি খাওলা বিনতে আজওয়ার (রা.)-এর সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে আলজেরিয়ার খাওলা বলা হয়। লালা ফাতিমা ১৮৩০ সালে আলজেরিয়ার কাবিলা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সিদ আহমেদ মুহাম্মদ  একটি মাদরাসার পরিচালক ও রাহমানিয়া সুফিধারার পীর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইসলামী শিক্ষা ও অনুশাসনের ভেতর বেড়ে ওঠেন।

১৮৩০ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীন আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন শুরু হয়। ১৮৪৯ সালে তরুণ ফাতিমা মুহাম্মদ আল-হাশেমির নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৮৪৭ সাল থেকে দাহরা অঞ্চলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এখানেই শরীফ বাউবাগলার, যাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে দেখা হয় লালা ফাতিমার। শরীফ বাউবাগলা ১৮৫০ সালে বাবর পর্বতমালায় প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর প্রতিরোধযুদ্ধ সুমার ও তাজমাত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৮৫৪ সালে শরীফ বাউবাগলা শহীদ হলে লালা ফাতিমা প্রতিরোধযুদ্ধের নেতৃত্ব লাভ করেন। তাঁর পাঁচ ভাই এ সময় প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেয় এবং তাঁকে সর্বাত্মক সাহায্য করে। তাঁর সফল নেতৃত্ব ও তেজস্বী বক্তৃতা বহু যুবককে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে সাত হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা ছিল।

লালা ফাতিমা বহু সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ১৮৫৪ সালের বসন্তে একটি ফরাসি সেনাদল চার্লস জোসেফ ফ্রান্সিস উলফের নেতৃত্বে সুমার গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে সেবাউ নদীর তীরে আইন আল-হাম্মামের কাছে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। আশপাশের গ্রামগুলো আগ্রাসনমুক্ত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধে ফাতিমা লালা সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

আলজেরীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান মার্শাল জ্যাক লুইস র‌্যান্ডনের নেতৃত্বে আরেকটি ফরাসি সেনাদল গ্রীষ্মকালে অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযান প্রতিরোধযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সফল প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়। ‘তাচেককির্ক’ যুদ্ধে শরীফ বাউবাগলার বাহিনী ফরাসিদের পরাজিত করে এবং উভয় বাহিনী একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, যা পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত বহাল ছিল। গ্রীষ্মকালীন অভিযানে ২৪ হাজার ফরাসি সৈনিক অংশ নেয় এবং সংঘাতে কমপক্ষে আট শ ফরাসি সৈনিক নিহত হয়।

১৮৫৭ সালে ফরাসি বাহিনী যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে জেনারেল পেট্রিক ডি ম্যাকমোহন ও মার্শাল র‌্যান্ডনের নেতৃত্বে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে কাবিলা অঞ্চলের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং বেশ কিছু এলাকা ফরাসিরা দখল করে নেয়। অন্যদিকে চিল্লাটা গিরিপথের যুদ্ধে লালা ফাতিমার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তারা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর ছোট ছোট গেরিলা অভিযান চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১১ জুলাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল জোসেফ ভ্যান্তিনি কয়েক ভাই ও কাবিলি নেতাদেরসহ লালা ফাতিমাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে মার্শাল র‌্যান্ডনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাবলাত-এ অবস্থিত আল-উসওয়া খানকায় লালা ফাতিমাকে বন্দি রাখা হয়। ১৮৬৩ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ফরাসি লেখিকা এমিলি ক্যারি কারাগারে লালা ফাতিমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি লেখেন, ‘সে বন্দি হওয়ার পর সমস্ত প্রতিরোধ থেমে যায় এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হয়। ’ লালা ফাতিমার বন্দিজীবন কোরআন তিলাওয়াত ও ইবাদত-বন্দেগিতেই কাটে। লালা ফাতিমাকে আলজেরিয়ার জাতীয় বীর মনে করা হয়। আলজেরিয়ার শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতে তিনি এখনো অমর হয়ে আছেন। ‘দ্য ডটার্স অব লালা ফাতিমা নসুমার’ আলজেরিয়ার নারীবাদী সংগঠন। ১৯৯৫ সালে ফ্রান্স তাঁর দেহাবশেষ হস্তান্তর করলে তাঁকে আলজেরিয়ার ঐতিহাসিক ‘আল-আলিয়া’ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এখানেই দেশটির জাতীয় বীর ও নেতারা ঘুমিয়ে আছেন।

তথ্যঋণ : প্রবন্ধ : লাল্লা ফাতিমা এন’সুমার (১৮৩০-১৮৬৩): স্প্রিচুয়ালি, রেসিস্ট্যান্স অ্যান্ড উওম্যানলি লিডারশিপ ইন কলোনিয়াল আলজেরিয়া; আলজেরিয়া ডটকম; উইকিপিডিয়া

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মিয়ানমারের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি না থাকা বড় ভুল

আলজেরীয় প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন যে হাফেজা

আপডেট সময় ১২:০৮:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২২

লালা ফাতিমা নাসুমার। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান বীরাঙ্গনা। যিনি অসীম সাহসিকতায় ফরাসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং আলজেরিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। লালা ফাতিমা নাসুমার ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম ও পীরের কন্যা।

নিজেও ছিলেন একজন হাফেজা ও আলেমা। বীরাঙ্গনা সাহাবি খাওলা বিনতে আজওয়ার (রা.)-এর সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে আলজেরিয়ার খাওলা বলা হয়। লালা ফাতিমা ১৮৩০ সালে আলজেরিয়ার কাবিলা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সিদ আহমেদ মুহাম্মদ  একটি মাদরাসার পরিচালক ও রাহমানিয়া সুফিধারার পীর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইসলামী শিক্ষা ও অনুশাসনের ভেতর বেড়ে ওঠেন।

১৮৩০ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীন আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন শুরু হয়। ১৮৪৯ সালে তরুণ ফাতিমা মুহাম্মদ আল-হাশেমির নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৮৪৭ সাল থেকে দাহরা অঞ্চলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এখানেই শরীফ বাউবাগলার, যাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে দেখা হয় লালা ফাতিমার। শরীফ বাউবাগলা ১৮৫০ সালে বাবর পর্বতমালায় প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর প্রতিরোধযুদ্ধ সুমার ও তাজমাত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৮৫৪ সালে শরীফ বাউবাগলা শহীদ হলে লালা ফাতিমা প্রতিরোধযুদ্ধের নেতৃত্ব লাভ করেন। তাঁর পাঁচ ভাই এ সময় প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেয় এবং তাঁকে সর্বাত্মক সাহায্য করে। তাঁর সফল নেতৃত্ব ও তেজস্বী বক্তৃতা বহু যুবককে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে সাত হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা ছিল।

লালা ফাতিমা বহু সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ১৮৫৪ সালের বসন্তে একটি ফরাসি সেনাদল চার্লস জোসেফ ফ্রান্সিস উলফের নেতৃত্বে সুমার গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে সেবাউ নদীর তীরে আইন আল-হাম্মামের কাছে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। আশপাশের গ্রামগুলো আগ্রাসনমুক্ত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধে ফাতিমা লালা সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

আলজেরীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান মার্শাল জ্যাক লুইস র‌্যান্ডনের নেতৃত্বে আরেকটি ফরাসি সেনাদল গ্রীষ্মকালে অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযান প্রতিরোধযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সফল প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়। ‘তাচেককির্ক’ যুদ্ধে শরীফ বাউবাগলার বাহিনী ফরাসিদের পরাজিত করে এবং উভয় বাহিনী একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, যা পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত বহাল ছিল। গ্রীষ্মকালীন অভিযানে ২৪ হাজার ফরাসি সৈনিক অংশ নেয় এবং সংঘাতে কমপক্ষে আট শ ফরাসি সৈনিক নিহত হয়।

১৮৫৭ সালে ফরাসি বাহিনী যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে জেনারেল পেট্রিক ডি ম্যাকমোহন ও মার্শাল র‌্যান্ডনের নেতৃত্বে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে কাবিলা অঞ্চলের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং বেশ কিছু এলাকা ফরাসিরা দখল করে নেয়। অন্যদিকে চিল্লাটা গিরিপথের যুদ্ধে লালা ফাতিমার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তারা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর ছোট ছোট গেরিলা অভিযান চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১১ জুলাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল জোসেফ ভ্যান্তিনি কয়েক ভাই ও কাবিলি নেতাদেরসহ লালা ফাতিমাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে মার্শাল র‌্যান্ডনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাবলাত-এ অবস্থিত আল-উসওয়া খানকায় লালা ফাতিমাকে বন্দি রাখা হয়। ১৮৬৩ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ফরাসি লেখিকা এমিলি ক্যারি কারাগারে লালা ফাতিমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি লেখেন, ‘সে বন্দি হওয়ার পর সমস্ত প্রতিরোধ থেমে যায় এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হয়। ’ লালা ফাতিমার বন্দিজীবন কোরআন তিলাওয়াত ও ইবাদত-বন্দেগিতেই কাটে। লালা ফাতিমাকে আলজেরিয়ার জাতীয় বীর মনে করা হয়। আলজেরিয়ার শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতে তিনি এখনো অমর হয়ে আছেন। ‘দ্য ডটার্স অব লালা ফাতিমা নসুমার’ আলজেরিয়ার নারীবাদী সংগঠন। ১৯৯৫ সালে ফ্রান্স তাঁর দেহাবশেষ হস্তান্তর করলে তাঁকে আলজেরিয়ার ঐতিহাসিক ‘আল-আলিয়া’ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এখানেই দেশটির জাতীয় বীর ও নেতারা ঘুমিয়ে আছেন।

তথ্যঋণ : প্রবন্ধ : লাল্লা ফাতিমা এন’সুমার (১৮৩০-১৮৬৩): স্প্রিচুয়ালি, রেসিস্ট্যান্স অ্যান্ড উওম্যানলি লিডারশিপ ইন কলোনিয়াল আলজেরিয়া; আলজেরিয়া ডটকম; উইকিপিডিয়া