একসময় ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। দিনমজুর বাবার সম্পত্তি ছিল মাত্র ৪ শতক। ঝিনাইদহের পুকুরিয়া গ্রামের বাজারে বাদাম বিক্রিসহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করতেন নাসির চৌধুরী। ভুয়া সনদে ৮ম শ্রেণি পাশ দেখানো সেই নাসির এখন কোটিপতি। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে দিনের পর দিন জমি রেজিস্ট্রির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চালু করেছিলেন ‘নাসির ট্যাক্স’ নামে অঘোষিত রেওয়াজ। তার অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত অত্যাচার-নির্যাতন। হত্যার হুমকি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হতো মুখ। একসময় দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলা নাসিরের অঢেল সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। এ ঘটনায় মামলা হলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখছে না।
এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে দলিল লেখক নাসির চৌধুরীর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ। ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মোশাররফ হোসেন ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযুক্ত নাসির ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর হিসাবে ৫ কোটি ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪ টাকা জমা রাখার প্রমাণ পায়। এছাড়াও নাসিরের নামে ৫৯.২৭ বিঘা জমির সন্ধান পায় দুদক। এ মামলার পর ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি দলিল লেখক নাসির চৌধুরী, তার দুই স্ত্রী এবং এক স্বজনের ১১টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতের নির্দেশানুযায়ী, অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামি কালীগঞ্জের শিমলা-রোকনপুর ইউপির চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক নাসির উদ্দিন চৌধুরীর চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এছাড়া তার এক স্ত্রী খোদেজা বেগমের ব্র্যাক ব্যাংকের দুটি হিসাব, দ্বিতীয় স্ত্রী মাহফুজা বেগমের সোনালী ব্যাংক যশোরের চুরামনকাঠি শাখার দুটি হিসাব জব্দ করা হয়। তালিকায় চেয়ারম্যানের এক স্বজন ঝিনাইদহের কুলফডাঙ্গা গ্রামের মিকাইল হোসেন জোয়ার্দ্দারের ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখার তিনটি হিসাব রয়েছে। সব মিলিয়ে ওই চার ব্যক্তির ১১টি হিসাব জব্দ করা হয়। এরপর প্রায় ৪ বছর হয়ে গেলেও এ মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।
দুদকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, নাসির চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী খোদেজা বেগমের নামে যশোরের আল-আরাফাহ্ ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। যার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নং-০৩০১৬২০০০১০২৫। ২য় স্ত্রী মাহফুজা খাতুনের নামেও রাখা আছে ৫০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ১৪ মে যশোরের আল-আরাফাহ্ ব্যাংকে ০৩০১৬২০০০১২৪৮নং হিসাব খোলা হয়। নাসির চৌধুরীর ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখায় ৮টি হিসাব নাম্বারে লাখ লাখ টাকার তথ্য পেয়েছে অনুসন্ধানী দল। ব্র্যাক ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০২নং হিসাবে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ পর্যন্ত জমা ছিল ২০ লাখ টাকা। একই ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৩নং হিসাবে জমা ছিল ২১ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১নং অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৮নং অ্যাকাউন্টে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯২০ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৪নং অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৪ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৭নং অ্যাকাউন্টে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫১ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১নং অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ১৪২ টাকা ও ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৬নং অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকে মাহফুজা ও তার শ্যালক জিয়া কবীরের নামেও রয়েছে কোটি কোটি টাকা। কালীগঞ্জ শহরের আড়পাড়ায় নাসিরের ৩টি আলিশান বাড়ি, নদীপাড়ায় একটি ও কুল্ল্যাপাড়ায় একটি বাগানবাড়ি রয়েছে। এছাড়া শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বেনামে দেড় কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন তিনতলা ভবন। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, দলিল লেখক নাসিরের কালীগঞ্জের বাবরা, পুকুরিয়া, তিল্লা, ডাকাতিয়া, এ্যাড়েখাল, মনোহরপুর, শিমলাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০০ বিঘা জমি রয়েছে।
পুকুরিয়া গ্রামের আকাশ ইসলাম বলেন, নাসির ও তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। তার মতের বাইরে গেলে মামলা-হামলা করা হতো। আমাকে ও তার চাচা বসিরকেও মারধর করা হয়েছে। প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বলেন, নাসির একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় তার অত্যাচার থেকে দলের লোকজনও রেহাই পায়নি। আকাশ, নজরুলের মতো নাসিরের অপকর্মের সাক্ষী এলাকার অনেক নির্যাতিত মানুষ।
প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে চলে জুলুম : আনোয়ারুল আজীম আনারের আস্থা অর্জনের পর সরকারি ফি’র অতিরিক্ত ‘নাসির ট্যাক্স’ নামে অঘোষিত রেওয়াজ চালু করেন নাসির। কেউ প্রতিবাদ করলেই এমপির দলীয় লোকজন ও নাসিরের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হুমকি এমনকি নির্যাতনও করা হতো। এ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদেরও নির্যাতন করতেন তিনি। এসব কাজে নেতৃত্ব দেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিচুর রহমান মিঠু মালিথা ও তার ভাই সুন্দর আলী। এমপি আনারকে বশে রাখতে দামি প্রাইভেটকারও উপহার দিয়েছেন নাসির। দুদকের মামলা থেকে বাঁচতে এমপি আনারকে নিয়ে যশোরে দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ে তদবিরও করিয়েছেন তিনি। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় ২০০ জনকে টাকা দিতেন নাসির। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মাসিক চুক্তিতে টাকা দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান একসময়ের প্রভাবশালী নাসির।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে দলিল লেখক নাসিরকে মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
ঝিনাইদহ দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, কিছুদিন আগে মামলার কাগজপত্র পেয়েছি। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যেই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।