বাংলাদেশে লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। এদেশে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কারণেই হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে হেপাটাইটিস বি নির্মূলে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১-এর কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলোজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।
তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীরা ভর্তি হন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত লিভার রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া প্রতি বছর দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে এক-তৃতীয়াংশ রোগী লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ডা. মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর দেশে বহু মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি লিভার রোগের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলের সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ বিষয়ে সফল হতে অবশ্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে। শুধুমাত্র করোনা মহামারি যে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে তা নয়, দেশে লিভার বিশেষজ্ঞ ও বিশেষায়িত লিভার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেরও ঘাটতি রয়েছে। অবশ্য তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১২ জনের ১ জন হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত। তবে এই আক্রান্ত মানুষগুলোর ১০ শতাংশেরও জানা নেই যে তারা এমন কঠিন রোগে ভুগছেন। এর অন্যতম কারণ হলো—এসব রোগীদের লিভার অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে থাকে না। কাজেই হেপাটাইটিস বি নির্মূলের এসডিজি গোলটি অর্জন করতে হলে সবার আগে জনসচেতনতা তৈরি এবং ব্যাপকভাবে স্ক্রিনিং কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোগী শনাক্তে জোর দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রোটারি ক্লাবের ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট গবর্নর ইঞ্জিনিয়ার এম এ ওয়াহাব বলেন, বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত করতে রোটারি ক্লাব ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় হেপাটাইটিস বি নির্মূলেও আমরা কাজ শুরু করেছি। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলে ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, হেপাটাইটিস বি নির্মূলে হাজারও সচেতন রোটারিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা এসডিজি গোল ৩ দশমিক ৩ অর্জনে বদ্ধপরিকর। এখন থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সনাক্ত করার জন্য রোটারির উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে সচেতনতা ও স্ক্রিনিং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
অনুষ্ঠানে হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে সচেতনতা খুবই জরুরি। লিভার ভালো রাখার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে তাহলে হেপাটাইটিস বি’র সংক্রমণ অনেকটাই কমে যাবে। এক্ষেত্রে রোটারি ক্লাবের জেলা কমিটিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এদেশে ১০ লাখ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য এসব হিসাব-নিকাশও প্রায় ৫ বছরের পুরাতন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা খরচ আরও বাড়বে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বসবাস করেন। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। তারা প্রত্যেকেই জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।