দ্বিতীয় ওয়ানডেতে যেভাবে শুরু হয়েছিল আর যেভাবে শেষটা হলো তাতে ভড়কে যাওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ৬৯ রানে ৬ উইকেট হারানো। তার পর মেহেদী হাসান মিরাজের অতিমানবীয় সেঞ্চুরিতে ৭ উইকেটে ২৭১ রান! ভারতের অবস্থাও শোচনীয় ছিল জবাবে। ৬৫ রানে পড়ে ৪ উইকেট! সেখান থেকে শ্রেয়াস আইয়ার ও অক্ষর প্যাটেলের ১০৭ রানের জুটি ভাঙলে ম্যাচ হেলে যায় বাংলাদেশের দিকে। তখনও বোঝা যায়নি চোট আক্রান্ত রোহিত শর্মা শেষটায় কতটা রোমাঞ্চ জমিয়ে রেখেছিলেন। হঠাৎ ক্রিজে নেমে বাংলাদেশের জয়ের পথে বাধা হতে চেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু মিরাজের দারুণ ব্যাটিংয়ের পর শেষের ঝলকটা দেখালেন মোস্তাফিজ। তার দুর্দান্ত বোলিংয়েই ভারতীয় অধিনায়ক শেষ বলে আর ৬ রান নিতে পারলেন না। তাতে বাংলাদেশ ৫ রানে জিতে ওয়ানডে সিরিজ এক ম্যাচ হাতে রেখেই নিশ্চিত করেছে।
শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে শেষ তিন ওভারে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪০ রান। আর সেই কঠিন সময়েই ১৮তম ওভারে মোস্তাফিজ একটি রানও নিতে দেননি। শেষ ১২ বলে লক্ষ্য থাকে একই। তবে মাহমুদউল্লাহর প্রথম বলে ছক্কা মেরে ব্যবধান কমাতে সমর্থ হন রোহিত। পরের বলে আসে অতিরিক্ত চার রান। তিন নম্বর বলে রোহিতকে জীবন দেওয়ার বিলাসিতাও করেন এবাদত। জীবন পেয়ে পরের বলে আবারও ছক্কা মেরে রোহিত ম্যাচ বাঁচিয়ে রাখেন। ভাগ্যও তখন সহায় ছিল তার। পঞ্চম বলে আবারও ক্যাচ উঠলে এবার সেটি হাতছাড়া করেন এনামুল। শেষ বলে সিরাজকে ক্লিন বোল্ড করেন মাহমুদউল্লাহ। ততক্ষণে শেষ ওভারে নতুন লক্ষ্য দাঁড়িয়ে গেছে ২০। তারপরও মোস্তাফিজের ওভারে ভয় ধরিয়ে দেন রোহিত। দুটি চার ও একটি ছক্কা মেরে জয়ের প্রায় কাছে চলে এলেও শেষটায় ইয়র্কার মেরে সব সম্ভাবনার ইতি ঘটান মোস্তাফিজ। ভারত ৯ উইকেটে থামে ২৬৬ রানে।
এই জয়ের মূল নায়ক মিরাজ হলেও পার্শ্বনায়ক অবশ্যই মোস্তাফিজ। প্রথম ম্যাচে এই দুজনের কাঁধে চড়েই বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল। প্রথম ম্যাচে মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে শেষ উইকেটে ৫১ রানের অবিশ্বাস্য এক জুটিতে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। দ্বিতীয় ম্যাচে মিরাজ রাখলেন আরও বড় ভূমিকা। প্রথমে অবিশ্বাস্য এক ইনিংসে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে মাঠ ছেড়েছেন। পরে লোকেশ রাহুল ও শ্রেয়াস আইয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যাটারকে সাজঘরের পথ দেখিয়েই তো পথের কাঁটা সরিয়েছেন তিনি। তারপর শেষ দুই ওভারে স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করে বোলিং করেছেন মোস্তাফিজ। এমন পারফরম্যান্সের পর তাই তো দুই ম্যাচেই দলের মধ্যমণি হয়ে রইলেন দুজন। গ্যালারিতে তাদের নিয়ে চলেছে হর্ষধ্বনি।
এমন উৎসব হওয়ারই কথা। ২০১৫ সালে প্রথমবার মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছিল। ৭ বছর পর এই মিরপুরে আরও একবার জন্ম দেওয়াে গেলো আরেকটি সুখস্মৃতির। এক ম্যাচ হাতে রেখে ভারতের বিপক্ষে আরও একটি সিরিজ জয়ের আনন্দে মাতলো লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।
অথচ বাংলাদেশের শুরুটা ছিল ভীতিকর! টস জিতে ব্যাট করতে নামলে ৬৯ রানে হাওয়া হয়েছে ৬ উইকেট! ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ব্যাটিং লাইনে তখন অতিমানবীয় কিছুই প্রয়োজন ছিল। যে রূপটায় দেখা গেলো মেহেদী হাসান মিরাজকে। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলেন। অবিশ্বাস্য এক ইনিংসে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির মাইফলকে পৌঁছান মিরাজ। একই সুরে ব্যাটিং করেছেন মাহমুদউল্লাহ, খেলেছেন ৭৭ রানের কার্যকর ইনিংস। এই দুজনের ব্যাটিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দল ৭ উইকেটে ২৭১ রানের ইনিংস গড়ে।
নাজমুল শান্ত-সাকিব আল হাসান মিলে কিছুক্ষণ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় থাকলেও সেটি উমরান মালিকের গতির সামনে টেকেনি। ৩৫ বলে ৩ চারে ২১ রান করা শান্তর স্টাম্প উপড়ে ফেলেন ভারতের এই পেসার। শ্লথ গতিতে খেলা ও উমরানের গতির কাছে পরাস্ত সাকিবও ফিরে যান একটু পর। ২০ বলে ৮ রান করা ব্যাটারকে দেখে মনে হচ্ছিল উমরানের বাউন্সারগুলো তাকে ভালোভাবেই আঘাত করেছে। ওয়াশিংটনের বলে পরে ধাওয়ানকে ক্যাচ দিয়ে শেষ হয়েছে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারের ইনিংস। চাপে পড়ে যাওয়া মুহূর্তে অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনও দলের ত্রাতা হতে পারেননি। ওয়াশিংটনের ঘূর্ণিতেই দুজন পর পর সাজঘরে ফিরেছেন। সাজঘরে ফেরার আগে মুশফিক ২৪ বলে ১২ রান করেছেন।
৬৬ থেকে ৬৯ অর্থাৎ ৩ রানের মধ্যে বাংলাদেশ দল সাকিব, মুশফিক ও আফিফের মতো গুরুত্বপূর্ণ তিন ব্যাটারকে হারিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিল। তারপর সেখানে থেকে দলকে টেনে তোলার দায়িত্বটা নেন মাহমুদউল্লাহ-মিরাজ। প্রথম ম্যাচে মোস্তাফিজকে নিয়ে মিরাজ শেষ উইকেটে ৫১ রানের জুটি গড়ে দলকে দুর্দান্ত এক জয় এনে দিয়েছেন। বুধবার মাহমুদউল্লাহকে নিয়েও পালন করেছেন গুরুদায়িত্ব। অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে দারুণ এক ইনিংস উপহার দিয়েছেন অফস্পিনিং অলরাউন্ডার। ৫৫ বলে ৩ চার ও ২ ছয়ে মিরাজ ৫০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। প্রথম পঞ্চাশ ৫৫ বলে করলেও দ্বিতীয় ৫০ ছুঁয়েছেন ২৮ বলে। সব মিলিয়ে ৮৩ বলে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন এই ব্যাটার। যা আবার ৮ নম্বরে নেমে কোনও ব্যাটারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি! ৮ চার ও ৪ ছক্কায় মিরাজ নিজের ইনিংসটি সাজিয়েছেন।
মিরাজের হাফসেঞ্চুরি পর পর মাহমুদউল্লাহও তুলে নেন ক্যারিয়ারের ২৭তম হাফসেঞ্চুরি। উমরান মালিকের বলে দুর্দান্ত এক ক্যাচে পরিণত হওয়ার আগে ৯৬ বলে ৭ চারে মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন ৭৭ রানের ইনিংস। শেষ দিকে নাসুমও কার্যকর একটি ইনিংস খেলেছেন। ১১ বলে ১৮ রান আসে নাসুমের ব্যাট থেকে। শেষটা এতই বারুদ ঠাসা ছিল, ৫ ওভারে মাহমুদউল্লাহ, নাসুম ও মিরাজ মিলে ৬৮ রান তুলেছেন।
টপ অর্ডার ব্যাটারদের সহজে নাস্তানাবুদ করতে পারলেও মাহমুদউল্লাহ, মিরাজ ও নাসুমের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছে ভারতীয় বোলারদের। ৩৭ রান খরচায় ওয়াশিংটন সুন্দর সর্বোচ্চ তিনটি উইকেট নিয়েছেন। এছাড়া উমরান মালিক ও মোহাম্মদ সিরাজ দুটি করে উইকেট নিয়েছেন।
তারপর আঙুলের চোটে অধিনায়ক রোহিত শর্মার ওপেনিংয়ে নামা হয়নি। ফলে ৮ বছর পর ওপেনিং করতে নেমেছিলেন বিরাট কোহলি। সঙ্গে ছিলেন শিখর ধাওয়ান। দ্বিতীয় ওভারে ওপেনিং জুটি ভেঙে বাংলাদেশকে উৎসবে ভাসান এবাদত হোসেন। শর্ট লেংথের বল পুল করতে গেলে ইনসাইড এজ হয়ে কোহলি বোল্ড হয়েছেন। তৃতীয় ওভারে আরেক ওপেনার শিখর ধাওয়ানকে বিদায় দেন মোস্তাফিজ। শর্ট লেংথের বল বুঝতে পারেননি তিনি। ক্যাচ উঠে বল জমা পড়ে মিরাজের হাতে। শুরুতে বিপদে পড়ে গেলে ২৬ রান যোগ করে ধাক্কা সামাল দেন শ্রেয়াস আইয়ার-ওয়াশিংটন সুন্দর। তাদের প্রতিরোধ ভাঙেন সাকিব আল হাসান। তার ঘূর্ণিতে ক্যাচ তুলে ১১ রানে ফিরেছেন ওয়াশিংটন।
লোকেশ রাহুল-শ্রেয়াস আইয়ারের জুটিও স্থায়ী হয়নি তারপর। ২৬ রান যোগ করা এই জুটি ভেঙে ভারতকে আরও বিপদে ফেলেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তার ঘূর্ণি ভারতের সহ-অধিনায়ক বুঝতেই পারেননি। লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে ১৪ রানে ফিরেছেন। ভারত তখন ভীষণ চাপে পড়ে গেলেও ধীরে ধীরে শ্রেয়াস আইয়ার ও অক্ষর প্যাটেলের ব্যাটেই জয়ের জন্য লড়তে থাকে তারা। ১০৭ রান যোগ করে আশার সঞ্চারও করে এই জুটি। শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক শ্রেয়াসকে তালুবন্দি করিয়ে জুটি ভেঙেছেন মিরাজ। তার পর অক্ষরকে সাকিবের ক্যাচ বানিয়ে ফের ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে স্বাগতিক দল।
ফেরার আগে শ্রেয়াস ১০২ বলে ৮২ রান করেছেন। তাতে ছিল ৬টি চার ও ৩ ছয়। অক্ষর প্যাটেল আবার ৫৬ বলে ৫৬ রান করেছেন।
সপ্তম উইকেট হিসেবে শার্দুল ঠাকুর আউট হওয়ার পর ক্রিজে নামেন রোহিত। তখনই দলকে উদ্ধারের শেষ চেষ্টাটা করেছেন তিনি। মাঝে চাহার, সিরাজ ফিরলেও শেষ পর্যন্ত ২৮ বলে ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংস উপহার দিয়ে বৃথা চেষ্টা করেছেন রোহিত।
এবাদত ৪৩ রান খরচায় তিনটি উইকেট নিয়েছেন। ৪৭তম ওভারে মাঠ ছাড়ার আগে মিরাজ ৬.১ ওভার বোলিং করে দুই উইকেট নিয়েছেন। এছাড়া সাকিব দুটি, মোস্তাফিজ ও মাহমুদউল্লাহ একটি উইকেট নিয়েছেন।
বাংলাদেশ: ২৭১/৭ (১০০*, মাহমুদউল্লাহ ৭৭; ওয়াশিংটন ৩/৩৭, উমরান ২/৫৮, সিরাজ ২/৭৩)
ভারত: ২৬৬/৯ (শ্রেয়াস ৮২, অক্ষর ৫৬, রোহিত ৫১*; এবাদত ৩/৪৫, মিরাজ ২/৪৬, সাকিব ২/৩৯)
ফল: বাংলাদেশ ৫ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: মেহেদী হাসান মিরাজ।