বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে স্বল্প আয়ের দেশগুলো বেশ চাপে পড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।বাংলাদেশেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মানও পড়ছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়ছে সাড় তিন গুণ।
একই সময়ে ঋণের বিপরীতে মূল অর্র্থ পরিশোধ বেড়েছে সোয়া ৫ গুণ। ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে সাড়ে ৫ গুণের বেশি।
মঙ্গলবার রাতে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট রিপোর্ট-২০২২’ শীর্ষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক ঋণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ। ২০১০ সালে বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৬৫৭ কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১৪৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে সব খাতেই বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ঋণ বাড়ায় এর বিপরীতে মূল অর্থ পরিশোধ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সুদ পরিশোধও। একই সময়ের ব্যবধানে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) গত দুই বছরের তুলনায় কমেছে। সার্বিক ভাবে বৈদেশিক ঋণের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়েনি।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল এই সাত বছরে ঋণ বেড়েছে ৫১০৪ কেটি ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৭০৯ কোটি ডলার, ২০১৯ সালে হয়েছে ৬২৪৩ কোটি ডলার, ২০২০ সালে হয়েছে ৭৩৫১ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ৯১৪৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ের মধ্যে ২০২০ সাল থেকে দেশের বৈদেশিক ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আগে তুলনামূলকভাবে ঋণ কম বেড়েছিল। মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২০১০ সালে ছিল ২২০০ কোটি ডলার। গত বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০৪ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২০১০ সালে ছিল ২৯৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে হয়েছে ১৮০৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে দেড় হাজার কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২০১৭ সালেই হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে তা আবার কমে ৯০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। ২০২০ সালে তা আবার হাজারের ঘর অতিক্রম করে। ২০২১ তা বেড়ে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি চলে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের চাপই বেশি। কেননা এসব ঋণ কম সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ে। আমদানির তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী না হলেই ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এসব দেশকে চাপে পড়তে হয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় চাপে পড়ে। এ চাপ সামাল দিতে এখন কম সুদের শর্তযুক্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে এসব দেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শর্ত এড়াতে এসব দেশ (স্বল্প উন্নত) চড়া সুদের বাণিজ্যিক ঋণই বেশি নিয়ে থাকে। কিন্তু কম সুদের শর্তযুক্ত বহুমুখী ঋণ নেয় কম। এসব ঋণ দিয়ে থাকে বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থাগুলো। যে কারণে স্বল্পোন্নত দেশের ওপর বৈদেশিক ঋণের চাপ বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মূল অংশের কিস্তির পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮২ কোটি ডলার। গত বছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪২১ কোটি ডলার। একই সময়ের ব্যবধানে সুদ পরিশোধ ২০ কোটি ডলার থেকে ১০৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে মূল ঋণের পরিশোধ বেড়েছে সোয়া ৫ গুণ, সুদ পরিশোধের কিস্তি বেড়েছে সাড়ে ৫ গুণের বেশি। স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ বেশি নেওয়ার কারণেই এ খাতে চাপ বেশি পড়েছে। কম সুদে ঋণ নিলে এই চাপ পড়ত না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এফডিআই কমে যাচ্ছে। ২০১০ সালে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৮৮ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ১৪৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে আবার কমে ১২৪ কোটি ডলার, ২০১৯ সালে সামান্য বেড়ে ১৩০ কোটি ডলার, ২০২০ সালে আরও একটু বেড়ে ১৩৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। গত বছর তা আবার কমে দাঁড়িয়েছে ১৩১ কোটি ডলারে। শেয়ারবাজারে পোর্ট ফোলিও বিনিয়োগ ২০১০ সালে কমেছিল সাড়ে ৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে তা বেড়েছিল ২৬ কোটি ডলার, ২০১৮ সালে ৩৩ কোটি ডলার কমেছিল, ২০১৯ সালে ৭০ কোটি ডলার কমেছে। ২০২০ সালে কমেছে ২৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০২১ সালে কমেছে ২৭ কোটি ডলার।