হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রানিগাও ইউনিয়নের ১ ও ২ নং ওয়ার্ডের হাওড় অঞ্চলের মাঝে অবস্থিত যুগির আসন নামক একটি রহস্যঘেরা স্থান স্থানীয়দের কাছে আজও অনেকটা অজানা। তবে স্থানটি ঘিরে প্রচলিত নানা জনশ্রুতি ও গুপ্তধনের সম্ভাবনার কারণে উৎসুক মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। সম্প্রতি, সেখানে বড় আকারের খনন কাজ শুরু হওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যুগির আসন নামক জায়গাটির নামকরণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। উত্তর রানিগাওয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজেন্দ্র দেবনাথ ভজন জানান, তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা যায়, বহু বছর আগে এখানে যুগি নামের এক ধ্যানে মগ্ন ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ব্রাহ্মণের চেয়েও উচ্চ পদাধিকারী সাধক ছিলেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সেই সময় থেকেই তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে পূজা ও হরিলুট দিয়ে আসছেন এবং সেই প্রথা আজও বিদ্যমান। অন্যদিকে, উত্তর রানিগাওয়ের মুসলিম পরিবারের মিজানুর রহমান জানান, এই স্থানে একসময় কোনো রাজার বাড়ি ছিল। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহজালাল (রহ.) যখন সিলেটে আসেন, তখন গৌড় গোবিন্দ রাজার সাথে যুদ্ধ হয়। মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর আযানের ধ্বনিতে সিলেট বিভাগের আওতাধীন বহু হিন্দু বাড়িঘর ও রাজার বাড়িসহ ভেঙে যায়। মিজানুর রহমান আরও বলেন, এখানে একটি বিল ছিল এবং সেই বিলে (সম্ভবত কোনো টিলার উপরে সমতল স্থান) রাজা ও রানী স্নান করতেন। লাঙ্গুলিয়া নদী দিয়ে বিল হয়ে রাজা-রানীর বাড়িতে নৌকা চলাচল করত। এই স্থানটি দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করে রেখেছে। স্থানীয়দের মধ্যে এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, টিলার নিচে কষ্টিপাথরের মূর্তি অথবা স্বর্ণের চেয়ার লুকানো আছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন সময় রাতের আঁধারে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বড় বড় গর্ত করে। মিজানুর রহমান জানান, সম্প্রতি ঢাকা থেকে কিছু লোক এসে বড় পরিসরে খনন কাজ শুরু করেছিল তারা ও কোনো সন্ধান পায়নি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই নির্জন স্থানটি অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মিজানুর রহমান জানান, আজ থেকে ৬-৭ বছর আগে পনারগাও গ্রামের এক ব্যক্তিকে যুগির আসনে এনে হত্যা করা হয়। এর এক-দেড় বছর পর আরও একটি মেয়েকে এখানে খুন করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, নির্জনতার কারণেই সম্ভবত খুনিরা এই স্থানটিকে বেছে নেয়। স্থানীয়দের কাছে যুগির আসন কেবল গুপ্তধনের সম্ভাবনাই নয়, এটি একটি পবিত্র স্থানও বটে। রাজেন্দ্র দেবনাথ ভজন বলেন, এটি তাদের একটি পূজার স্থান এবং তারা আজও প্রতি বছর এখানে হরিলুট দেন। পাছারগাঁও গ্রামের আবু তাহের জানান, ছোটবেলায় তিনিও এখানে হরিলুটে অংশ নিতেন এবং উড়ন্ত বাতাসা কুড়িয়ে খেতেন। বিভিন্ন সময় খননকালে এই স্থানে বড় আকারের ইট পাওয়া যায় এবং স্থানীয়রা সেগুলো তাদের বাড়িঘরের বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহার করেন।
এ বিষয়ে রানিগাও ইউনিয়নের বাসিন্দা ও সাংবাদিক মুহিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী রাজা আচক নারায়ণের বাড়ি ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে ছিল। রাজা মাছি রুপ ধারণ করে গাজী কালুর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে পালিয়ে যান। তিনি আরও জানান, ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী রাজার মা রঙ্গনারীর নামানুসারে রানিগাঁও গ্রামের নামকরণ হয়। মুহিদ আহমদ চৌধুরীর ধারণা, রাজার বাড়ির ধন সম্পদের লোভে একটি চক্র বারবার এই স্থানের মাটি খনন করছে। তিনি আরও জানান, এখানে একটি বিল ছিল এবং কালের পরিক্রমায় বিলের দুপার কেটে অনেকে কৃষি জমি হিসেবে ব্যবহার করছেন। রাজেন্দ্র দেবনাথ ভজন মনে করেন, যুগির আসনের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান, যদি সরকারি ভাবে এই স্থানটিকে সংরক্ষণ করা হতো, তবে তা তাদের সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত ভালো হতো। স্থানীয়দের বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে চুনারুঘাটের রানিগাওয়ের যুগির আসন এক রহস্যময় স্থান হিসেবে আজও বিদ্যমান। গুপ্তধনের অনুসন্ধান এবং অপরাধের কারণে স্থানটি যেমন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তেমনই স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র স্থান। কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি ও সংরক্ষণের উদ্যোগ এই ঐতিহাসিক স্থানটির ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
চুনারুঘাটের রানিগাওয়ে যুগির আসনে গুপ্তধনের খোঁজে খনন
-
মোঃ মাসুদ আলম চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি:
- আপডেট সময় ০৮:৩৮:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫
- ৫১৭ বার পড়া হয়েছে