বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রতি বছর দেশে আত্মহত্যায় মারা যাচ্ছে ১৩ হাজার মানুষ। এ হিসাবে গড়ে দৈনিক মারা যায় ৩৫ জন মানুষ। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, যারা আত্মহত্যা করছে তারা বয়সে কিশোর ও তরুণ এবং এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই শিক্ষার্থী। এই তালিকায় আরও আছে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, পারিবারিক কলহ, অভিমান, ঋণগ্রস্ত মানুষ, বেকার যুবক, প্রেমঘটিত কারণ, যৌন নির্যাতন এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার হিড়িক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাম্প্রতিক সময় লাইভে এসেও বেশ কজন মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। এতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
আত্মহত্যায় পিছিয়ে নেই গাজীপুর জেলা। এ জেলায় দিন দিন বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। জেলায় গত কয়েকমাসে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসবের কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, প্রেমঘটিত কারণে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আত্মহত্যায় এগিয়ে নারীরা। তারা নানা বিষয়ে অভিমানের কারণে কিংবা পারিবারিক কলহে আত্মহত্যার পথে পা বাড়ান।
আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক দল আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ৩১.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী এবং সমসংখ্যক পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়াও আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা। ৬৭.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল এই বয়সী। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১.৬ শতাংশ। ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২.৮০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৮.৩০ শতাংশ। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি ছিল। ২০২৪ সালে মোট ৩১০ জন আত্মহত্যা করেন, এর মধ্যে প্রায় ৬১ শতাংশ ছিল নারী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল। ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর হার ছিল ৬৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) বাৎসরিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে ১ হাজার ১৫১টি নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৪১৯ জন নারী। সংগঠনের সিনিয়র আইনজীবী নাহিদ শামস্ বলেন, বাংলাদেশের আইনে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং সেই মোতাবেক শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে স্বীয় শরীরের ওপর কোনো ধরনের আঘাত করলে তাকে পেনাল কোড ৩০৯ ধারা অনুসারে ১ বছর বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এ ছাড়া পেনাল কোড ৩০৬ ধারায় কেউ আত্মহত্যার প্ররোচনা দিলে, যদি সে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে প্ররোচনাদানকারীর শাস্তি পেনাল কোড ৩০৬ ধারা মোতাবেক ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং বিনাশ্রম বা সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এই আইনজীবীর মতে, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা আত্মহত্যা করার আগে সুইসাইড নোট লিখে যান। বাংলাদেশের প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ১৮৭২‑এর ৩২ ধারা অনুযায়ী, আত্মহত্যাকারীর রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট প্ররোচনাদানকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু সুইসাইড নোটের ওপর ভিত্তি করে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সুইসাইড নোটের সমর্থনে আরও সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
অনেকেই বলছেন, একমাত্র বাসযোগ্য ও ছায়া সুনিবিড় এই পৃথিবী থেকে মানুষের বিয়োগাত্মক পরিণতি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম অনাকাঙ্ক্ষিত কারণ আত্মহত্যা। যার সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত আমাদের চারপাশের পরিবেশ এবং ব্যক্তির আবেগ বা মন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আর তা থেকে জন্ম নেয়া তীব্র কষ্ট, হতাশাসহ অন্যান্য নেতিবাচক বিষয়ের সম্মিলিত ও চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহত্যা। যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, এর অন্যতম হচ্ছে বুলিং। চরম হতাশা ও অসহায় বোধ থেকে কিশোর-কিশোরীরা এই পথে পা বাড়ায়। মাদকাসক্তের মতো সমাজবিরোধী আচরণও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশে যেসব পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলো হলো- সাইবার ক্রাইমের শিকার, যৌতুক প্রথা, বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকা, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরি হারানো, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব, দরিদ্রতা, প্রতারণার শিকার, ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়া, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের তাচ্ছিল্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব, যৌন সহিংসতা এবং নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়মিত সন্তান কিংবা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে হবে।
জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ইতোমধ্যেই সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে তারা অভিভাবকদেরও সচেতন হতে বলেন।