দেশের সাধারণ মানুষ যখন মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট, অর্থনীতিতে চলছে সংকট, এমন পরিস্থিতিতেও আয় কমেনি বিত্তশালীদের। বাড়ছে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮ হাজার ৪৫৭টিতে। তিন মাস আগে ছিল এক লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি। এ বছরের শুরুতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে এর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে। আর এক বছর আগে ২০২১ সালের জুনে কোটি টাকার বেশি হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে ৮ হাজার ৫৩৯টি, ছয় মাসে বেড়েছে ৬ হাজার ৪৮১টি ও তিন মাসে বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬০টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের জুন ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ৫১৩টি। যাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩টি। তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।
এছাড়া ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬টি। সে সময় তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
কোটির টাকার হিসাব বেড়ে যাওয়াটা কীভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, এটা আয় ও সম্পদের বৈষম্য। বড়রা বেশি বড় হচ্ছে আর নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের আয় কমে যাচ্ছে।
সব ক্ষেত্রেই ছোটরা বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর বলেন, কোভিডের সময়ও বড় ব্যবসায়ীরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন। দেশের ব্যবসা থেকে শুরু করে বৈদেশিক বাণিজ্য সব জায়গায়ই বড় ব্যবসায়ীরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পান। আজকে খবরের কাগজে দেখলাম, ছোট ছোট রপ্তানিকারকদের রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংক প্রতি ডলারে ৯৫-৯৬ টাকা দিচ্ছে। এর বেশি না কি দেবে না। অথচ বড় বড় কারখানা ও গার্মেন্টের ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে ৯৯ থেকে ১০১ টাকা। এমন বৈষম্যের কারণে একটা শ্রেণির আয় বেড়েই চলছে।
তিনি বলেন, দেশে দুর্নীতি ও অর্থপাচার বেড়েছে। তারাও বিভিন্ন উপায়ে ব্যাংকের টাকা জমা রাখছে। এসব করণে সংকটের মধ্যেও কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৪১টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ এক লাখ ৭৬ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৮৬৫টি হিসাব। তাদের অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
এছাড়া ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৭৬৩টি, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৭১৯টি, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৫১ টি, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৩ জনের, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫০২টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩০৭ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৬২১টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৮০৫ টিতে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে পৌঁছায়।