ঢাকা ০৩:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা উত্তরের ট্যাক্স সুপারভাইজার যেভাবে ফ্ল্যাট মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন— তার একটি ঘটনা

ঢাকা উত্তরের ট্যাক্স সুপারভাইজার যেভাবে ফ্ল্যাট মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন— তার একটি ঘটনা
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ফ্ল্যাট মালিক তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে রিছাদের কাছে ১ লাখ টাকা জমাও দিয়েছেন। বাকি কাজ শেষে আরও এক লাখ করে টাকা দিতে হবে রিছাদকে। আর রিছাদও তার অফিসেই এসব ঘুষের লেনদেন ও চুক্তি করে আসছেন। এমনকি, ঘুষের টাকার হিসাব রাখার জন্য রিছাদ একটি খাতাও মেইনটেইন করেন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদ। ছবি: সংগৃহীত

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডের আবাসিক ভবন র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃনির্ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয় ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের।

এ সময় সিটি কর্পোরেশনের রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদ প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছে ২ লাখ করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং ফ্ল্যাট মালিকদের আশ্বস্ত করেন, তাদের ট্যাক্স যা আসবে— তার থেকে অনেক কমিয়ে দেওয়া হবে।

ওই ভবনের ৬২টি ফ্লাটের মধ্যে একটির মালিক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনিও সেদিন অন্যান্য মলিকদের সঙ্গে ওই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমার ফ্লাটের হোল্ডিং ট্যাক্স আমি বিগত বছরগুলোতে প্রতি বছর ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে আসছি। এখন যদি নতুন করে মূল্যায়ন করে, সেক্ষেত্রে ট্যাক্স বাড়লেও সেটা দিতে আমি রাজি আছি। কিন্তু অসুদপায় অবলম্বন করে ট্যাক্স কমানোর পক্ষে আমি নই।”

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “ওই কর্মকর্তাকে যদি ঘুষ না দেওয়া হয় তাহলে বর্তমানে যে টাকা দিচ্ছি, তার থেকে ২-৩গুণ ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া নানান জটিলতার বিষয়ে ফ্ল্যাট মালিকদের ভয় দেখানো হয়েছে।”

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) রেভিনিউ সুপারভাইজর রিছাদের গতিবিধির ওপর গভীর তদন্ত চালিয়েছে এবং প্রমাণ পেয়েছে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুধু র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টের ফ্ল্যাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আরও বিভিন্ন জায়গায় তিনি এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদের আওতায় গুলশানে প্রায় ২ হাজার হোল্ডিং এ এমন নোটিশ তিনি পাঠিয়েছেন এবং পর্যায়ক্রমে তাদের থেকেও ২, ৫, ১০ লাখ করে টাকা ঘুষ চাচ্ছেন।

শুধু মেহেদী হাসান রিছাদই গুলশান, বারিধারা, বনানীর প্রায় ২,০০০ হোল্ডিং থেকে অন্তত ৪০ কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঘুষদাতা এবং গ্রহীতা উভয়ই এ ধরনের লেনদেন থেকে উপকৃত হন বিধায়, এসব ঘটনা তেমন প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায় না।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ফ্ল্যাট মালিক তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে রিছাদের কাছে ১ লাখ টাকা জমাও দিয়েছেন। বাকি কাজ শেষে আরও এক লাখ করে টাকা দিতে হবে রিছাদকে। আর রিছাদও তার অফিসেই এসব ঘুষের লেনদেন ও চুক্তি করে আসছেন। এমনকি, ঘুষের টাকার হিসাব রাখার জন্য রিছাদ একটি খাতাও মেইনটেইন করেন।

বিষয়টি শিকারও করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক এক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে তিনি জানান, জোন-৩ এ ৮ জন রেভিনিউ সুপারভাইজর রয়েছেন, যারা করদাতাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের জন্য প্ররোচিত করতে, এমনকি চাপ দিতে মধ্যস্থতাকারীদের সাহায্য নেন।

তিনি বলেন, “ট্যাক্সের এমন কাজ করতে সিটি কর্পোরেশনে একটি চক্র কাজ করে। আমি নিজেও এই চক্রের বিরুদ্ধে চেষ্টা করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি।”

“দুদকে মামলাও হয়েছিল এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, কিন্তু পরবর্তীতে কিছু হয়েছে কি–না তা জানি না,” যোগ করেন তিনি।

রিছাদের অফিসে অনুসন্ধান

এই ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদক নিজেই একটি ফ্ল্যাটের মালিকের ম্যানেজারের সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক অফিসে রিছাদের কাছে যান গত ৬ নভেম্বর।

সেখানে প্রায় ৩ ঘণ্টা রিছাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন এই প্রতিবেদক।

শুরুতে রিছাদের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, তিনি একটি হোল্ডিংয়ের ট্যাক্স নিয়ে এক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছেন। ওই গ্রাহকের কাছে তার ট্যাক্স ফাইল ঠিক করে দিতে ৩ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন, কিন্তু গ্রাহক তাকে দেড় লাখ টাকা দিতে চান।

এক পর্যায়ে তাদের লেনদেন ২ লাখ টাকায় চুক্তি হয় এবং গ্রাহক রিছাদকে অগ্রিম ৩০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্তু রিছাদ ১ লাখ টাকা অগ্রিম চাচ্ছিলেন।

কথাবার্তার এক পর্যায়ে রিছাদ ওই গ্রাহককে নিয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমের (শৌচাগার) দিকে যান। সেখানে অগ্রিম টাকার লেনদেন মিটিয়ে প্রায় ৫ মিনিট পরে আবার রুমে প্রবেশ করেন। রুমে প্রবেশ করে, তিনি তার ঘুষ লেনদেনের হিসাব রাখার খাতাটি বের করে ওই গ্রাহকের নামের সামনে ৩০ হাজার টাকা (৩০কে) অগ্রিমের বিষয়টি লিখে রাখেন এবং বলেন, কাজ শেষ হলে কাগজ নেওয়ার সময় তাকে বাকি টাকা দিতে হবে।

এরপরে আসে আমাদের পর্ব।

আমরা তাকে জানাই, আমাদের হোল্ডিং গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডে এবং সেখানে আমাদের হোল্ডিং ট্যাক্স যাতে বাড়ানো না হয়, তার জন্য কী করতে হবে?

রিছাদ জানান, আমাদের ভবনের অন্যরা যে টাকার বিনিময়ে কাজ করেছেন, আমাদেরও সেই রেটেই তিনি কাজ করে দেবেন। আমার সাথে থাকা সোর্স, এমন একজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন, যিনি ওই ভবন থেকে রিছাদের কাছে অগ্রিম টাকা জমা দিয়েছেন।

এ সময় রিছাদ ফোনে বলেন, “ভাই আপনারটা যে রেটে করিয়ে দিচ্ছি, ভাইদেরটাও একই রেট দিলেই হবে। কাজ শুরু করার সময় অগ্রিম এক (এক লাখ টাকা) দিয়ে যাবেন এবং কাজ শেষ হলে বাকি এক দেবেন।”

“কাজ শেষ হতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে, কিন্তু এর মধ্যে কাউকেই অফিসে আসতে হবে না। আমি সব ঠিক করে রাখবো,” যোগ করেন রিছাদ।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে আর একটু কমানো যায় কিনা? এর উত্তরে তিনি বললেন, “ভাই, এর কম দিলে আমার কিছু থাকবে না। বিভিন্ন খাতে খরচ আছে। উপরেও (সিনিয়র কর্মকর্তাদের) তো দিতে হবে, বুঝেন না?”

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ফিরে এসে কাজ শুরুর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রিছাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং শেষ হয়।

অভিযোগ অস্বীকার করেন রিছাদ

১০ নভেম্বর, নিজের পরিচয় গোপন রেখে মুঠোফোনে রিছাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এই প্রতিবেদকের।

র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টের ফ্ল্যাট মালিকদের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে আনা ঘুষের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, রিছাদ তা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন’ বলে অস্বীকার করেন।

পরে, গত ১৩ নভেম্বর ঢাকা উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমের সঙ্গে দেখা করি।

তিনি বলেন, “আমরা এ ধরনের দুর্নীতি কখনও বরদাস্ত করবো না। আমরা এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আর আমরা শুধু একজনকেই নয়, এভাবে অনিয়ম করে আসা যদি কোনো চক্র থাকে, সেটিকেও শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবো।”

পরবর্তীতে রিছাদ বুঝতে পারেন, সপ্তাহখানেক আগে পরিচয় গোপন রেখে ‘ক্লায়েন্ট’ ছদ্মবেশে এই প্রতিবেদক তার অফিসে গিয়েছিলেন। বিষয়টি বোঝার পর প্রতিবেদককে ফোন করেন রিছাদ এবং দাবি করেন, বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

তিনি বলেন, “হয়তো ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে কেউ মিথ্যা অভিযোগ করেছে। আমি বিভিন্ন ভবনে গিয়ে নোটিশ দেওয়ার সময় মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং ট্যাক্সের বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছি এটা সত্য, কিন্তু কোনো ঘুষ দাবি করিনি।”

তিনি আরও বলেন, “গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডের কয়েকটি হোল্ডিং এ কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে গ্রাহকরা আমার কাছে আসেন, কিন্তু আমি কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেইনি। তারাই আমাকে টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আমি কোনো টাকা চাইনি।”

এ বিষয়ে অঞ্চল-৩ এর কর কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, “বার্ষিক কর মূল্যায়নের চিঠি যাচ্ছে গুলশান এলাকায় এটা ঠিক, কিন্তু ঘুষ দাবি করার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।”

“আমিও এখানে নতুন এসেছি, তাই এখানের মানুষগুলো চিনতে পারিনি। মানুষগুলো চিনতেও একটু সময় লাগবে,” যোগ করেন তিনি।

এ ধরনের অপরাধ একই সাথে ৩ ধরনের দুর্নীতি

জনগণের ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে এমন অপরাধ সংগঠিত হলে, তা একই সাথে ত্রিমাত্রিক অপরাধ সংগঠিত হওয়া বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “প্রথম অপরাধ হচ্ছে, এটা সরাসরি দুর্নীতি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তৃতীয় অপরাধ হচ্ছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করছেন।”

“কারণ তিনি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া মানে রাষ্ট্র ট্যাক্স কম পাচ্ছে। তার এই অপরাধের কারণে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,” বলেন তিনি।

এমন অপরাধকে গর্হিত বিবেচনা করে এই কাজের সঙ্গে ওই কর্মকর্তাসহ আরও যারা জড়িত, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তির দাবি করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দেশের এই পরিবর্তীত অবস্থায় এ ধরনের অপরাধ কোনোভাবেই কাম্য নয়। দ্রুত বিষয়টি আমলে নিয়ে অপরাধীদের চিহ্নিত করার জোর দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে, “দেশের এত বড় একটি পরিবর্তন হলেও সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতিবাজ আগের লোকেরাই রয়ে গেছেন। সিটি কর্পোরেশনের এমন ঘটনা হতাশাজনক, এতে নগরবাসী বৈধ পথে না গিয়ে অসৎ চক্রের সাথে জড়িয়ে যাবে। এতে নগর ব্যবস্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

এদিকে, ঢাকা উত্তরের উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, “রেভিনিউ বিভাগে অনেক জায়গায়ই সমস্যা আছে এবং বিভিন্ন সময় অভিযোগও আসে। এর আগেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে এই সুপারভাইজারের এমন অভিযোগ আমরা পাইনি।”

“এমন অভিযোগ পেলে আমাদের সংস্কারপন্থীরা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি। আর এক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্সের রেট অনলাইনেই প্রকাশিত থাকে,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢাকা উত্তরের ট্যাক্স সুপারভাইজার যেভাবে ফ্ল্যাট মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন— তার একটি ঘটনা

আপডেট সময় ১১:০৯:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ঢাকা উত্তরের ট্যাক্স সুপারভাইজার যেভাবে ফ্ল্যাট মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন— তার একটি ঘটনা
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ফ্ল্যাট মালিক তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে রিছাদের কাছে ১ লাখ টাকা জমাও দিয়েছেন। বাকি কাজ শেষে আরও এক লাখ করে টাকা দিতে হবে রিছাদকে। আর রিছাদও তার অফিসেই এসব ঘুষের লেনদেন ও চুক্তি করে আসছেন। এমনকি, ঘুষের টাকার হিসাব রাখার জন্য রিছাদ একটি খাতাও মেইনটেইন করেন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদ। ছবি: সংগৃহীত

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডের আবাসিক ভবন র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃনির্ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয় ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের।

এ সময় সিটি কর্পোরেশনের রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদ প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছে ২ লাখ করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং ফ্ল্যাট মালিকদের আশ্বস্ত করেন, তাদের ট্যাক্স যা আসবে— তার থেকে অনেক কমিয়ে দেওয়া হবে।

ওই ভবনের ৬২টি ফ্লাটের মধ্যে একটির মালিক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনিও সেদিন অন্যান্য মলিকদের সঙ্গে ওই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমার ফ্লাটের হোল্ডিং ট্যাক্স আমি বিগত বছরগুলোতে প্রতি বছর ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে আসছি। এখন যদি নতুন করে মূল্যায়ন করে, সেক্ষেত্রে ট্যাক্স বাড়লেও সেটা দিতে আমি রাজি আছি। কিন্তু অসুদপায় অবলম্বন করে ট্যাক্স কমানোর পক্ষে আমি নই।”

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “ওই কর্মকর্তাকে যদি ঘুষ না দেওয়া হয় তাহলে বর্তমানে যে টাকা দিচ্ছি, তার থেকে ২-৩গুণ ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া নানান জটিলতার বিষয়ে ফ্ল্যাট মালিকদের ভয় দেখানো হয়েছে।”

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) রেভিনিউ সুপারভাইজর রিছাদের গতিবিধির ওপর গভীর তদন্ত চালিয়েছে এবং প্রমাণ পেয়েছে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুধু র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টের ফ্ল্যাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আরও বিভিন্ন জায়গায় তিনি এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রেভিনিউ সুপারভাইজার মেহেদী হাসান রিছাদের আওতায় গুলশানে প্রায় ২ হাজার হোল্ডিং এ এমন নোটিশ তিনি পাঠিয়েছেন এবং পর্যায়ক্রমে তাদের থেকেও ২, ৫, ১০ লাখ করে টাকা ঘুষ চাচ্ছেন।

শুধু মেহেদী হাসান রিছাদই গুলশান, বারিধারা, বনানীর প্রায় ২,০০০ হোল্ডিং থেকে অন্তত ৪০ কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঘুষদাতা এবং গ্রহীতা উভয়ই এ ধরনের লেনদেন থেকে উপকৃত হন বিধায়, এসব ঘটনা তেমন প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায় না।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ফ্ল্যাট মালিক তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে রিছাদের কাছে ১ লাখ টাকা জমাও দিয়েছেন। বাকি কাজ শেষে আরও এক লাখ করে টাকা দিতে হবে রিছাদকে। আর রিছাদও তার অফিসেই এসব ঘুষের লেনদেন ও চুক্তি করে আসছেন। এমনকি, ঘুষের টাকার হিসাব রাখার জন্য রিছাদ একটি খাতাও মেইনটেইন করেন।

বিষয়টি শিকারও করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক এক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে তিনি জানান, জোন-৩ এ ৮ জন রেভিনিউ সুপারভাইজর রয়েছেন, যারা করদাতাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের জন্য প্ররোচিত করতে, এমনকি চাপ দিতে মধ্যস্থতাকারীদের সাহায্য নেন।

তিনি বলেন, “ট্যাক্সের এমন কাজ করতে সিটি কর্পোরেশনে একটি চক্র কাজ করে। আমি নিজেও এই চক্রের বিরুদ্ধে চেষ্টা করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি।”

“দুদকে মামলাও হয়েছিল এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, কিন্তু পরবর্তীতে কিছু হয়েছে কি–না তা জানি না,” যোগ করেন তিনি।

রিছাদের অফিসে অনুসন্ধান

এই ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদক নিজেই একটি ফ্ল্যাটের মালিকের ম্যানেজারের সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক অফিসে রিছাদের কাছে যান গত ৬ নভেম্বর।

সেখানে প্রায় ৩ ঘণ্টা রিছাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন এই প্রতিবেদক।

শুরুতে রিছাদের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, তিনি একটি হোল্ডিংয়ের ট্যাক্স নিয়ে এক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছেন। ওই গ্রাহকের কাছে তার ট্যাক্স ফাইল ঠিক করে দিতে ৩ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন, কিন্তু গ্রাহক তাকে দেড় লাখ টাকা দিতে চান।

এক পর্যায়ে তাদের লেনদেন ২ লাখ টাকায় চুক্তি হয় এবং গ্রাহক রিছাদকে অগ্রিম ৩০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্তু রিছাদ ১ লাখ টাকা অগ্রিম চাচ্ছিলেন।

কথাবার্তার এক পর্যায়ে রিছাদ ওই গ্রাহককে নিয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমের (শৌচাগার) দিকে যান। সেখানে অগ্রিম টাকার লেনদেন মিটিয়ে প্রায় ৫ মিনিট পরে আবার রুমে প্রবেশ করেন। রুমে প্রবেশ করে, তিনি তার ঘুষ লেনদেনের হিসাব রাখার খাতাটি বের করে ওই গ্রাহকের নামের সামনে ৩০ হাজার টাকা (৩০কে) অগ্রিমের বিষয়টি লিখে রাখেন এবং বলেন, কাজ শেষ হলে কাগজ নেওয়ার সময় তাকে বাকি টাকা দিতে হবে।

এরপরে আসে আমাদের পর্ব।

আমরা তাকে জানাই, আমাদের হোল্ডিং গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডে এবং সেখানে আমাদের হোল্ডিং ট্যাক্স যাতে বাড়ানো না হয়, তার জন্য কী করতে হবে?

রিছাদ জানান, আমাদের ভবনের অন্যরা যে টাকার বিনিময়ে কাজ করেছেন, আমাদেরও সেই রেটেই তিনি কাজ করে দেবেন। আমার সাথে থাকা সোর্স, এমন একজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন, যিনি ওই ভবন থেকে রিছাদের কাছে অগ্রিম টাকা জমা দিয়েছেন।

এ সময় রিছাদ ফোনে বলেন, “ভাই আপনারটা যে রেটে করিয়ে দিচ্ছি, ভাইদেরটাও একই রেট দিলেই হবে। কাজ শুরু করার সময় অগ্রিম এক (এক লাখ টাকা) দিয়ে যাবেন এবং কাজ শেষ হলে বাকি এক দেবেন।”

“কাজ শেষ হতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে, কিন্তু এর মধ্যে কাউকেই অফিসে আসতে হবে না। আমি সব ঠিক করে রাখবো,” যোগ করেন রিছাদ।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে আর একটু কমানো যায় কিনা? এর উত্তরে তিনি বললেন, “ভাই, এর কম দিলে আমার কিছু থাকবে না। বিভিন্ন খাতে খরচ আছে। উপরেও (সিনিয়র কর্মকর্তাদের) তো দিতে হবে, বুঝেন না?”

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ফিরে এসে কাজ শুরুর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রিছাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং শেষ হয়।

অভিযোগ অস্বীকার করেন রিছাদ

১০ নভেম্বর, নিজের পরিচয় গোপন রেখে মুঠোফোনে রিছাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এই প্রতিবেদকের।

র‌্যাংগস ওয়াটারফ্রন্টের ফ্ল্যাট মালিকদের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে আনা ঘুষের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, রিছাদ তা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন’ বলে অস্বীকার করেন।

পরে, গত ১৩ নভেম্বর ঢাকা উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমের সঙ্গে দেখা করি।

তিনি বলেন, “আমরা এ ধরনের দুর্নীতি কখনও বরদাস্ত করবো না। আমরা এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আর আমরা শুধু একজনকেই নয়, এভাবে অনিয়ম করে আসা যদি কোনো চক্র থাকে, সেটিকেও শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবো।”

পরবর্তীতে রিছাদ বুঝতে পারেন, সপ্তাহখানেক আগে পরিচয় গোপন রেখে ‘ক্লায়েন্ট’ ছদ্মবেশে এই প্রতিবেদক তার অফিসে গিয়েছিলেন। বিষয়টি বোঝার পর প্রতিবেদককে ফোন করেন রিছাদ এবং দাবি করেন, বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

তিনি বলেন, “হয়তো ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে কেউ মিথ্যা অভিযোগ করেছে। আমি বিভিন্ন ভবনে গিয়ে নোটিশ দেওয়ার সময় মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং ট্যাক্সের বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছি এটা সত্য, কিন্তু কোনো ঘুষ দাবি করিনি।”

তিনি আরও বলেন, “গুলশান-১ এর ১৫ নং রোডের কয়েকটি হোল্ডিং এ কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে গ্রাহকরা আমার কাছে আসেন, কিন্তু আমি কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেইনি। তারাই আমাকে টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আমি কোনো টাকা চাইনি।”

এ বিষয়ে অঞ্চল-৩ এর কর কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, “বার্ষিক কর মূল্যায়নের চিঠি যাচ্ছে গুলশান এলাকায় এটা ঠিক, কিন্তু ঘুষ দাবি করার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।”

“আমিও এখানে নতুন এসেছি, তাই এখানের মানুষগুলো চিনতে পারিনি। মানুষগুলো চিনতেও একটু সময় লাগবে,” যোগ করেন তিনি।

এ ধরনের অপরাধ একই সাথে ৩ ধরনের দুর্নীতি

জনগণের ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে এমন অপরাধ সংগঠিত হলে, তা একই সাথে ত্রিমাত্রিক অপরাধ সংগঠিত হওয়া বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “প্রথম অপরাধ হচ্ছে, এটা সরাসরি দুর্নীতি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তৃতীয় অপরাধ হচ্ছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করছেন।”

“কারণ তিনি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া মানে রাষ্ট্র ট্যাক্স কম পাচ্ছে। তার এই অপরাধের কারণে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,” বলেন তিনি।

এমন অপরাধকে গর্হিত বিবেচনা করে এই কাজের সঙ্গে ওই কর্মকর্তাসহ আরও যারা জড়িত, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তির দাবি করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দেশের এই পরিবর্তীত অবস্থায় এ ধরনের অপরাধ কোনোভাবেই কাম্য নয়। দ্রুত বিষয়টি আমলে নিয়ে অপরাধীদের চিহ্নিত করার জোর দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে, “দেশের এত বড় একটি পরিবর্তন হলেও সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতিবাজ আগের লোকেরাই রয়ে গেছেন। সিটি কর্পোরেশনের এমন ঘটনা হতাশাজনক, এতে নগরবাসী বৈধ পথে না গিয়ে অসৎ চক্রের সাথে জড়িয়ে যাবে। এতে নগর ব্যবস্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

এদিকে, ঢাকা উত্তরের উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, “রেভিনিউ বিভাগে অনেক জায়গায়ই সমস্যা আছে এবং বিভিন্ন সময় অভিযোগও আসে। এর আগেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে এই সুপারভাইজারের এমন অভিযোগ আমরা পাইনি।”

“এমন অভিযোগ পেলে আমাদের সংস্কারপন্থীরা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি। আর এক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্সের রেট অনলাইনেই প্রকাশিত থাকে,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।