চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের প্রভাবমুক্ত করতে গত ৩ সেপ্টেম্বর আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০ দিনের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো ব্যাংকটির আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বহাল তবিয়তে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, এস আলম গ্রুপ ও কেডিএস গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দুজনকে ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকের অভ্যন্তরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন সাইফুল আলম মাসুদের ভাই আব্দুস সামাদ লাবুর বোর্ডের নিয়োগ করা ফরমান আর চৌধুরী। নতুন বোর্ড দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তাকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের দুজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ এবং কেডিএস গ্রুপের কর্ণধার খলিলুর রহমানের পরামর্শেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে কয়েকজনের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
তথ্য বলছে, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে সাইফুল আলম মাসুদ সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ব্যাংক থেকে তার ভাইয়ের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও কেডিএস গ্রুপ। বর্তমান পর্ষদ ওই ঋণগুলো পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিজের অনুগত লোক বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয় এস আলম ও কেডিএস। যার ধারাবাহিতকায় ব্যাংকের আগের ডিএমডিরা থাকার পরও এস আলমের অনুগত অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে বাইরে থেকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের বাহির থেকে কয়েকজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করায় নিজস্ব কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। নিয়োগ হলেই আন্দোলনে যেতে পারেন সব কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, ব্যাংকে বর্তমানে ৭ জন ডিএমডি থাকার পরও কেন বাইরে থেকে কর্মকর্তা আনতে হবে। এ ছাড়া যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে জানতে পেরেছি। এই দুজনকেই নিয়োগের জন্য আয়োজন চলছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরীকে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল ধরেননি।
১২১৭ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগ: আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের তিন শাখায় ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে ঠিকমতো জামানত রাখেনি গ্রাহক। স্বল্প জামানতে বিপুল পরিমাণ ঋণসীমা অনুমোদন করেছে
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বনানী শাখার গ্রাহক মেসার্স আয়মন টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারিকে ৪১২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। যাচাই-বাছাই না করে দেওয়া এই ঋণের অর্থ ব্যবসার কাজে না লাগিয়ে পাচারের অভিযোগ এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ঋণটি এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা মেসার্স চিটাগাং ইস্পাত, মেসার্স এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস ও ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রির অনুকূলে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানি মেসার্স এরিয়াল মেরিটাইম প্রাইভেট লিমিটেড থেকে জাহাজ আমদানির জন্য আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক যে লোন দিয়েছিল, তা থেকে বর্তমানে বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১৩৫.৫৩ কোটি টাকা (অনারোপিত ক্ষতিপূরণসহ)। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। এ ঋণের বিপরীতে গ্রাহকের কাছে থেকে মাত্র ১৭ কোটি টাকার সহায়ক জামানত নেওয়া হয়েছে।
তথ্য বলছে, সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজ রপ্তানি করা কোম্পানি মেসার্স এরিয়াল মেরিটাইম প্রাইভেট লিমিটেড মূলত আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানেরই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিদেশে বিনিয়োগ করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতির বিধান রয়েছে। যে অনুমোদন নেই মেসার্স এরিয়াল মেরিটাইম প্রাইভেট লিমিটেডের।
২০১০ সালে সাড়ে ৮ কোটি টাকার জামানতের বিপরীতে ৮৫ কোটি টাকার ঋণসীমা দেওয়া হয়। এরপর যাত্রাবাড়ী শাখায় চারটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান (মেসার্স জেএসটি কমোডিটিজ, মেসার্স এলহাম টেক্সটাইল, মেসার্স ইউনিলন টেক্সটাইল ও মেসার্স তাফরীদ কটন মিল) দেখিয়ে সেই ঋণসীমা ৬৬৯ কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। যার বিপরীতে সহায়ক জামানত হিসেবে দেখানো জমির মূল্য মাত্র ১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সেই জমির মূল দলিল, বায়া দলিল ও পর্চা কিছুই নেই। সবমিলে ৫০ কোটি টাকার জামানতের বিপরীতে ৬৬৯ কোটি টাকার ঋণসীমা অনুমোদন করেছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। উল্লেখিত চারটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বদিউর রহমানের বড় জামাতা শাহাবুল ইসলামের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। তবে বদিউর রহমানের দাবি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে কোনো ঋণ নেই।
আল-আরাফাহ জানায়, আগে জামানত না থাকলেও এখন প্রচুর পরিমাণ সম্পদ জামানত নিয়ে ঋণকে নিরাপদ করা হয়েছে।