২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন মো. খাইরুল ইসলাম। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছাকাছি থাকার সুবাদে হয়েছেন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। চাকরিতে পেয়েছেন নজিরবিহীন পদোন্নতি।
খাইরুল ইসলাম মূলত মান্নান নামে সবার কাছে পরিচিত। বর্তমানে অবসরে থাকা এই কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলার আসামি হয়েও সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বাগিয়েছিলেন। এ নিয়ে বেশ আলোচিতও হন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয় নজর কেড়েছে, তা হলো দেশ-বিদেশে তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিপুল সম্পদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ৫ কাঠা আয়তনের একটি প্লটে সাততলা বাড়ি, মোহাম্মদপুরে বীর উত্তম নুরুজ্জামান রোডের কসমোপলিটন ভবনে ৪ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস, ধানমন্ডি শেখ জামাল মাঠসংলগ্ন ‘কসবা’ ভবনে ২ হাজার ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, সায়েন্স ল্যাব-সংলগ্ন কলেজ স্ট্রিট রোডে একটি ১০ তলা ভবনে ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক সাবেক এই আমলা। এ ছাড়া কুয়াকাটায় মহিপুর মৌজায় ১৫ একর জমি, বরিশালের দবদবিয়া ব্রিজের পাশে একটি বাংলো, বরগুনার আমতলীতে একটি পেট্রলপাম্পও আছে এই আমলার। এ ছাড়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে তাঁর ১০ শতাংশ শেয়ার ছিল বলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে পরে তিনি সেই শেয়ার হস্তান্তর করেছেন বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রাজউক উত্তরা আবাসিক প্রকল্পে নিজ নামে নেওয়া ৫ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে বছর তিনেক আগে সাততলা ভবন নির্মাণ করেন খাইরুল ইসলাম। তথ্য গোপন করে একই প্রকল্প থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী ইসরাত জাহানের নামেও একটি প্লট বাগিয়ে নেন। সেখানেও একটি ভবন করা হয়েছে। যদিও রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে সরকারি প্লট নেওয়ার সুযোগ নেই। রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের একটি প্লট রেখে অন্যটি বাতিল করা হবে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক সচিব খাইরুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে গেলে সেখানেও তালা ঝুলতে দেখা যায়।
চাকরিতে থাকা অবস্থায় নিজ নামে একাধিক ব্যবসা শুরু করেছিলেন খাইরুল ইসলাম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ২২/২ বীর উত্তম নুরুজ্জামান রোডের কসমোপলিটন ভবনের ছয়তলায় রয়েছে তাঁর নিজ নামে কেনা একটি বাণিজ্যিক স্পেস। প্রায় ৪ হাজার বর্গফুটের এই অফিসে এস এম ট্রাভেলস এবং মেঘমালা কনস্ট্রাকশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। মেঘমালা খাইরুল ইসলামের বড় মেয়ের নাম বলে জানা গেছে। তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে অফিসটিতে তালা ঝুলছে।
জানা যায়, খাইরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রীর বড় মেয়ে মেঘমালা এবং ছেলে সৌরদ্বীপ যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। সেখানে মেয়ে মেঘমালার নামে দুটি বাড়ি কিনেছেন খাইরুল। আর দ্বিতীয় স্ত্রী ইসরাত জাহানকে বছর পাঁচেক আগে তুরস্কে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। তুরস্কের বিধিবিধান মেনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ইসরাত নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ১৫ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব হন খাইরুল ইসলাম। পরের ১১ বছরে একে একে তিনটি পদোন্নতি নিয়ে সর্বশেষ গত বছরের ২ জুলাই সচিব হিসেবে অবসরে যান। এরপরও সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি তাঁকে সচিব পদমর্যাদায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সদস্য হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি তার এই চুক্তি বাতিল করেছে সরকার।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় সরকার বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে খাইরুল ইসলাম তাঁর অফিস কক্ষটি অনেকটা রাজনৈতিক নেতাদের আড্ডাস্থলে পরিণত করেছিলেন। এ কর্মকর্তাকে যখন সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়, তখন তিনি ঋণখেলাপি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ মামলার আসামি। এমনকি ১৩তম ব্যাচ ডিঙিয়ে ১৫তম ব্যাচের খাইরুল ইসলামকে এককভাবে পদোন্নতি দেওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তৎকালীন প্রশাসন।
ঢাকা শহরে নিজের ও স্ত্রীর নামে একাধিক ভবন থাকলেও খাইরুল ইসলাম থাকেন রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবের কলেজ স্ট্রিটে সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের একটি বাংলোয়। ২০০৯ সালে সিনিয়র সহকারী সচিব থাকা অবস্থায় এই বাংলো বরাদ্দ দেন তিনি। সাধারণত সরকারের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা না হলে এ ধরনের বাংলো বরাদ্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু খাইরুল ইসলাম এটি বরাদ্দ নেন জুনিয়র কর্মকর্তা থাকাকালে। একতলার এই বাংলো এখনো তাঁর নামে বরাদ্দ রয়েছে বলে জানা গেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা আবদুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে বেশ সখ্য ছিল খাইরুল ইসলামের। সেই সুবাদে ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি তিনি। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এই কর্মকর্তা। ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিছু ফেরত দিলেও বাকিটা শোধ না করায় সুদাসলে তাঁর দেনা হয় কমবেশি ৯ কোটি টাকা। এরপর বেসিক ব্যাংক পাওনা আদায়ে খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গত বছরের ১৩ নভেম্বর মামলা করেছে। মামলা নম্বর ১৪০২। এ মামলায় তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পরে আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে পড়েন তিনি। অর্থঋণ আদালতে মামলার সঙ্গে দুদক থেকেও খাইরুল ইসলামের নামে একটি মামলা করা হয়।