পেশায় চিকিৎসক হলেও করেন না চেম্বার প্র্যাকটিস। তাই সরকারি চাকরির বেতন-ভাতাদি ছাড়া তার বৈধ আয়ের কোনো অবলম্বন নেই। কিন্তু তিনি ৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাটের মালিক। প্রায় কোটি টাকা দামের দুটি গাড়িও রয়েছে তার। উপরন্তু বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে তার এবং তার নিকটাত্মীয়দের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রাখার অভিযোগও রয়েছে।
তার নাম ডা. হোসাইন ইমাম। ইমু নামেই সমধিক পরিচিত। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তিনি।
আওয়ামীপন্থি সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কার্যকরি পরিষদের সদস্য ডা. ইমামের মোট সম্পদের পরিমাণ শতকোটি টাকারও বেশি বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন তারই এক নিকটাত্মীয়। অথচ পৈতৃক সূত্রে তিনি তেমন কিছুই পাননি। এরপরও কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন ইমাম?
এ প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ব্যানারে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে নিজের পদায়ন ও নজিরবিহীন পদোন্নতি, পদপ্রাপ্তির পর সরকারি হাসপাতালে একচেটিয়া টেন্ডারবাজি, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, সরঞ্জাম সরবরাহে পুকুরচুরিসহ নানা ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমেই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন মানবসেবার পেশায় যুক্ত এই হোসাইন ইমাম।
যেভাবে উত্থান
ডা. ইমামের শিক্ষাগত বৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১০ সালে অ্যাডহক/অস্থায়ী ভিত্তিতে মেডিক্যাল অফিসার (নন-ক্যাডার) পদে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। নিয়োগের পর ২ বছর গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তিনি এক বছর পরই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পোস্টিং নিয়ে চলে আসেন। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ায় চাকরিজীবনের শেষ পর্যন্ত একই পদে থাকার কথা থাকলেও ২০১৮ সালের মে মাসে তাকে বিধি-বহির্ভূতভাবে চলতি দায়িত্বে সহকারী অধ্যাপক (বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি) হিসেবে পদায়ন করা হয়। পরের বছরের জুনে (জিও নং: ২৯১, তারিখ-১৭/০৬/২০১৯) তাকে সহকারী অধ্যাপক (প্লাস্টিক সার্জারি) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পদায়ন করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাডারভুক্তির আগে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাকে ক্যাডার পদে এ রকম পদোন্নতি দেওয়া সরকারি চাকরির বিধিবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অন্য কোনো ক্যাডারে এমন নজির নেই।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাকে সহকারী পরিচালকের (একাডেমিক) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটি স্পষ্টতই নিয়মবহির্ভূত আদেশ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আর এসব পদে যাওয়ার পরপরই অতিমাত্রায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন ডা. ইমাম। জানা গেছে, ২০২৩ সালে চলতি দায়িত্বে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন করার পর তিনি সহকারী পরিচালকের (একাডেমিক) অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। কিন্তু আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতা হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আবারও সহকারী পরিচালকের (একাডেমিক) পদে আসীন হন। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এক বন্ধুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সংস্পর্শে আসেন তিনি। পরবর্তীকালে এই সম্পর্কের প্রভাব প্রয়োগ করেই ঘটে তার উত্থান।
বিত্তের মূলে টেন্ডার বাণিজ্য
বার্ন ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই হাসপাতালের কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত ডা. ইমাম। দরপত্র প্রস্তুতির যাবতীয় সব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে দরপত্র মূল্যায়ন ও দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটিতে রয়েছেন। ফলে পছন্দ মাফিক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইনস্টিটিউটের এক সহযোগী অধ্যাপক বলেন, নিজের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে নিজেই স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিতেন ডা. ইমাম। বিশেষ করে হাইপার্বারিক অক্সিজেন থেরাপির (এইচবিওটি) যন্ত্র বাজার মূল্যের চারগুণ বেশি টাকা দিয়ে কেনা হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এ যন্ত্রটি ৫০ লাখ টাকায় কিনলেও একই মানের যন্ত্র প্রতিটি দুই কোটি টাকায় কেনা হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। দুই দরপত্রে এইচবিওটি যন্ত্র কেনা হয়েছে ১০টি। অর্থাৎ ৫ কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হয় ২০ কোটি টাকায়।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের যন্ত্র কেনাকাটার কাজ ইমুর মাধ্যমে পায় দেশের খ্যাতনামা একটি কোম্পানি। এরপর কোম্পানিটি ইমুর যোগসাজশে প্রথমে সম্পূর্ণ অকার্যকর যন্ত্র সরবরাহ করে। সেটা মেরামত করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েন সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর এবং সহকারী অধ্যাপক নুরুন্নাহার লতা। তাদের প্রতিবাদে তৎকালীন পরিচালক আবুল কালাম আজাদ পুনরায় যন্ত্র আনাতে বাধ্য হন। তবে হাসপাতালে এই যন্ত্র পরিচালনার লোক নেই বলে প্রশিক্ষণের দোহাই দিয়ে ডা. ইমাম নিজে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেও তিনি এ পর্যন্ত একজনেরও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন বলে কোনো রেকর্ড নেই। চার ধরনের ১০টি লেজার মেশিন কেনার কাজ একটি কোম্পানিকে দেওয়ার বদৌলতে ডা. ইমামসহ দুই চিকিৎসককে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেয় কোম্পানিটি।
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবছর প্রায় ১৫ কোটি টাকার চিকিৎসা উপকরণ ও ওষুধের প্রয়োজন হয়। সেখানেও রয়েছে ইমুর হাত। গত দুই অর্থবছরে ওশন এন্টারপ্রাইজ, টেকনো ওয়ার্থ অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড ও তামাম করপোরেশনকে মোটা টাকার বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যা নিয়ে কমিটির অন্য সদস্যদের বরাবরই আপত্তি ছিল।
ল্যাব সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি কোম্পানির কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালে তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নেন হোসাইন ইমাম। কিন্তু সেই টেন্ডার কোম্পানিটি পায়নি। উল্টো উৎকোচ দেওয়া ২৫ লাখ টাকা চাইতে গিয়ে নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, হোসাইন ইমামের বিরুদ্ধে এমন আরও অনেকেরই বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ২৫/২৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে ডা. ইমাম প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাটের মালিক। যখন এটি কেনেন, তখন তিনি ছিলেন মেডিক্যাল অফিসার। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফ্ল্যাট সি-১১ এর মালিক তিনি। তার দুটি গাড়ি রয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকা। একটি নিজে ব্যবহার করেন, অন্যটি স্ত্রী-সন্তানরা। এ দুই গাড়ি থাকার পরও অতিরিক্ত সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে সরকারি গাড়ি বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে।
হোসাইন ইমাম যা বলছেন
পদোন্নতির বিষয়ে ডা. ইমাম বলেন, ‘অ্যাডহক হলেও সরকারি বিধি অনুযায়ী ১০ শতাংশ কোটা থাকে। এ কোটায় একাডেমিকভাবে যোগ্য হলে পদোন্নতি পাওয়া যায়। আমিও সেভাবেই পদোন্নতি পেয়েছি।’ আর ফ্ল্যাটের বিষয়ে বলেন, ‘বাসাটি আমার স্ত্রীর। তিনিও একজন চিকিৎসক। তার বাবার বাড়ি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া টাকায় ফ্ল্যাটটি ছয় বছর আগে বুকিং দেওয়া হয়। পরে ব্যাংক থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।’ গাড়ির বিষয়ে বলেন, ‘বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেনা হয়েছে।’
তবে এসব সম্পদের বিপরীতে ইনকাম ট্যাক্স, অডিট রিপোর্ট ও প্রয়োজনীয় বিবরণপত্র দেখতে চাইলে কোনো নথিপত্রই দেখাতে পারেননি তিনি।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
অবৈধ পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পদোন্নতি পরিচালকের অফিস থেকে হয় না। এমনকি আমাদের কোনো সুপারিশও লাগে না। কতটা নিয়ম মেনে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সেটা স্বাস্থ্য সচিব বলতে পারবেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী অ্যাডহক থেকে এমন পদোন্নতির সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইমুর সহকারী পরিচালক হওয়া নিয়ে সে সময় সংশ্লিষ্টদের বারবার বলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো ফল আসেনি।’
বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়াল বলেন, ‘পদোন্নতি কীভাবে পেয়েছে আমার জানা নেই, মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। দরপত্রের অনিয়মের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইনস্টিটিউটের গাড়ি ডা. ইমাম ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেটি বন্ধ করে দিয়েছি।’