সহকর্মীকে মারধরে রক্তাক্ত করায় অভিযুক্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সেই বিতর্কিত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (লিড, ডেপুটেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিজার্ভ) মো. আজিজুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এ ঘটনার আজিজুল ইসলামের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কীত পরিচালক (হিসাব, বাজেট ও নিরীক্ষা শাখা) বরুন কুমার দত্ত ইন্দন দাতা হিসাবে চিহ্নিত হলেও সে রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। তার বিরুদ্ধে এখোনও নেয়া হয়নি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
জানা যায়, মারধরের এ ঘটনায় ওই চিঠিতে আজিজুল ইসলামের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (হিসাব, বাজেট ও নিরীক্ষা শাখা) বরুন কুমার দত্তের বিরুদ্ধে ‘উপযুক্ত ব্যবস্থা’ নিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনার ‘ইন্ধনদাতা’ হিসেবে বরুন কুমার দত্তের নাম এসেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দরকে এই চিঠি দেওয়া হয়।
সচিবকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গত ১৪ জুন শুক্রবার এই চিঠি সই হলেও তা ১৫ জুন শনিবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগী কর্মকর্তা হলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মলয় কুমার শূর। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন চিঠি জারি করল অধিদপ্তর।
আজিজুল ও বরুনের নাম উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ডকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল বিধায় ভুক্তভোগী কর্মকর্তা মলয় কুমার শূরের আবেদন সুবিবেচনায় নেওয়া একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে বরুন কুমার দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এমন চিঠি সম্পর্কে তিনি জানেন না। তিনি আরো বলেন, ‘ইন্ধনদাতা, এটা আবার কেমন কথা। সবাইতো জ্ঞানী লোক, সচেতন লোক।’ শিক্ষিত মানুষকে কেউ ইন্ধন দিতে পারে, এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় একটি পাহাড়ের খবর নামে একটি গনমাধ্যমে ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার ২০২৩ এ প্রকাশিত সংবাদেও সূত্রে জানাযায়, পরিচালক বরুন কুমার দত্ত রাঙামাটি জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা থাকা কালে অভিযোগ আছে, এ কর্মকর্তা টাকার লোভ সামলাতে পারেন না। অঙ্ক যতই কম হোক যেখানে টাকা সেখানেই দায়িত নেন তিনি।
অভিযোগ আছে, জেলার আয় বর্ধক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নিস্ক্রিয় রেখে নিজে দায়িত্ব নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মাসৎ করেন ডা. বরুণ কুমার দত্ত।
তিনি জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা হলেও হাঁস, শুকর, মুরগি খামারসহ জেলার একাধিক উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।
এসব দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষন, উন্নয়ন, পশু পাখির খাদ্য ক্রয়, বিবিধ খাতের জন্য পাওয়া সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি জেলায় দায়িত্ব নেন ডাঃ বরুণ কুমার দত্ত। সেদিন ডাঃ মনোরঞ্জন ধরের কাছ থেকে আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও নেন বরুণ।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় সম্পুর্ণ সচল খামার বুঝে নেন। সে সময় হ্যাচারীর ৪ টি এসিসহ, ৩ ইনকিউবেটর (বাচ্চা উৎপাদন মেশিন) সচল ছিল। খামারের তিনটি শেডে ১ হাজার ৬৭৩ হাঁস ছিল। হ্যাচারীতে উৎপাদন হতো হাঁসের বাচ্চা। বরুণ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শুরু হয় হাঁস বিক্রির মহোৎসব।
তার আমলে ২০১৯ সালে জুলাইয়ে শুক্রবারের একদিনে খামারের পেছনের দরজা দিয়ে চুরি করে হাঁস বিক্রির খবর ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে প্রচার হলে বিভাগীয় তদন্ত হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বরুণ কুমার দত্ত ২০১৮ সালে রাঙামাটি পিগ (শুকর) খামারে দায়িত্ব থাকাকালীন সময় জুলাই মাসে রাঙামাটি জেলা পরিষদ উন্নত জাতের শুকরের বাচ্চা ক্রয়ের জন্য ৩ ধাপে ৬ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়। কিন্তু বরুণ দত্ত কোনো শুকর না কিনে টাকাগুলো আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া যায়। তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বৃষকেতু চাকমা।
বৃষকেতু চাকমা বলেন, আমার আমলে শুকর কেনার জন্য ৬ লাখ টাকা দিয়েছি তা সত্য। কিন্তু আমার আমলে শুকরের হিসাব দিতে পারেননি বরুণ। আমি যতদিন চেয়ারম্যান ছিলাম তার কার্যক্রম নিয়ে আমি খুব কষ্টে ছিলাম। তার সাথে আমি এমন আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি যা পরিষদের কোনো পিয়নের সাথেও এমন আচরণ করিনি।
তিনি আরো বলেন, আমার জীবনে এমন দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা দেখিনি। তাকে নিয়ে কত অভিযোগ! এগুলো বলে শেষ করা যাবে না। তাকে রাঙামাটি থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য দুই দফায় উপরে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু বদলি করা হয়নি। আমি যতদিন চেয়ারম্যান ছিলাম, ততদিন আমি তার এসিআর এ (এনুয়েল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট) অর্থাৎ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে কম নম্বর দিয়েছিলাম। সেই হিসাবে তার কোনো দিন পদোন্নতি হওয়ার কথা নয়।
জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে ভবন সংস্কারের জন্য পাওয়া ৪ লাখ টাকার কোনো কাজই করেননি বরুণ কুমার দত্ত। এদিকে জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের পাশে জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভবনকে অফিসার ডরমেটরি নাম দিয়ে ৪ বছরের অধিক সময় ধরে বিনা ভাড়ায় বসবাস করে আসছেন বরুণ কুমার দত্ত। এখানে তিনি দুটো অপরাধ করছেন। একদিকে বিনা ভাড়ায় থাকছেন অন্যদিকে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের অফিস দখল করে অফিসের কার্যক্রমে ক্ষতি করছেন।
এর পাশে কার্যালয় বিভাগের অন্য প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য বাসভবন বরাদ্দ থাকলেও এসব বাস ভবনে তাদের থাকতে দেন না বরুন কুমার দত্ত। এসব কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, বরুণ কুমার কার্যালয়ে অধীনস্ত এক চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক জড়িয়েছেন।এ পরিবারকে প্রথম শ্রেণী কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা বাস ভবন বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি নানান সুবিধা দিয়ে থাকেন বরুণ। ঐ নারীকে নিয়ে বরুণ দত্তকে হাঁস খামার এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর একাধিক ছবি পাওয়া যায়।