মুন্সীগঞ্জের সদর থানার কোর্টগাঁও এলাকায় ত্রিভুজ প্রেমের জেরে দশম শ্রেণির স্কুলছাত্রী জেসিকা মাহমুদ জেসি (১৬)কে শ্বাসরোধ করে নৃশংসভাবে হত্যা মামলার প্রধান আসামী প্রেমিক বিজয় রহমান (২২)কে রাজধানীর ওয়ারী থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেফতারকৃত বিজয় রহমান মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানার মধ্যকোর্টগাঁও আরিফুজ্জামান আরিফ এর পুত্র। র্যাব জানিয়েছে, ভিকটিম জেসিকা মাহমুদ জেসি মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানার -দক্ষিণ কোর্টগাঁও গ্রামের সেলিম দেওয়ানের কন্যা । সে মুন্সীগঞ্জ আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মুন্সীগঞ্জের কোর্টগাঁও এলাকায় বন্ধুর বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর রহস্যজনক ভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
আজ রোববার দুপুর ১২ টায় রাজধানীর কারওয়ানবাজারস্হ র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) এএসপি ফারজানা হকসহ র্যাবের বিভিন্ন পদমর্যাদা কর্মকর্তারা এসময় উপস্হিত ছিলেন।
খন্দকার আল মঈন জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার দিবাগত রাত ৮ টার দিকে র্যাব-৩ ও র্যাব-১১ এর যৌথ দল রাজধানীর ওয়ারী থানা এলাকায় ঝটিকা অভিযান চালিয়ে স্কুলছাত্রী জেসিকা মাহমুদ জেসিকে হত্যা মামলার প্রধান আসামী বিজয় রহমানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
হত্যাকান্ডের বিবরণ উল্লেখ করে র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত বিজয় রহমান এর সাথে আদিবা আক্তার এবং ভিকটিম জেসিকা মাহমুদ জেসি প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। প্রেমের সম্পর্কের মাঝে গ্রেফতারকৃত বিজয় এবং আদিবা আক্তার বিয়ের পরিকল্পনা করে। তাদের বিয়ের বিষয়টি ভিকটিম জেসিকা মাহমদু জেসি জানতে পারায় বিজয়ের সাথে তার বিভিন্ন কথাপোকথনের স্ক্রীনশর্ট এবং বিভিন্ন ভিডিও আদিবা আক্তারের মেসেঞ্জারে পাঠায়। সেগুলো দেখে প্রেমিক বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন অপর প্রেমিকা আদিবা। বিষয়টি নিয়ে বিজয় ও আদিবার মাঝে কথা কাটাকাটি হতে থাকে। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে বিজয় এবং আদিবা একত্রে যোগসাজসে জেসিকে উচিত শিক্ষা হিসেবে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত বিজয় বিষয়টি ফয়সালা করার অজুহাতে তার বাসায় দুই প্রেমিকা আদিবা ও ভিকটিম জেসিকে ডেকে নিয়ে আসে। তারা তাদের সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনার জন্য বিজয়ের বাসার ছাদে মিলিত হয়। অতঃপর সেখানে বিজয় রাগান্নীত হয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে থাকে ও জেসিকে আদিবার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে বলে। কিন্তু জেসি তার কথায় রাজি না হওয়ায় আদিবা জেসির গালে সজোরে থাপ্পর মারে। একপর্যায়ে জেসি সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে বিজয় এবং আদিবা দুই জনে মিলে জেসিকে এলোপাতাড়ি চর-থাপ্পর মারতে থাকে। তাদের অত্যাচারে তখনও জেসি ক্ষমা চাইতে রাজি না হলে বিজয় ও আদিবা মিলে জেসিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, তখন বিজয় ও আদিবা কোন দিকবিদিক না পেয়ে জেসির মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য ৫ তলা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। তৎক্ষনাত বিজয় ও আদিবা ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভিকটিমকে মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত বিজয় ভিকটিম জেসির ভাইকে জেসির অসুস্থতার কথা বলে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আসতে বলে। জেসির ভাই হাসপাতালে এসে পৌছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান জেসি আরও ১ ঘন্টা আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইনও গণমাধ্যম শাখার মূখপাত্র বলেন, জেসির মৃত্যুর ঘটনা শুনে গ্রেফতারকৃত আসামী বিজয় ও আদিবা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ভিকটিম জেসির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে জেসির ভাই জানতে পারে, জেসিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে জেসির ভাই মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানায় গ্রেফতারকৃত বিজয় ও তার অপর প্রেমিকা আদিবাসহ আরও ১/২ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
মামলা দায়েরের পর গত ৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ এ হত্যার প্রধান আসামী বিজয় এর অপরাপর সহযোগী আদিবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় এবং সে বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছে।
এদিকে, ভিকটিম জেসির পরিবারের সদস্যদের উদ্বিতি দিয়ে র্যাব বলছে, গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ আনুমানিক বিকেল ৪ টার দিকে গ্রেফতারকৃত বিজয় এবং আদিবা দু’ জনে ভিকটিম জেসিকার বাসায় গিয়ে জেসিকাকে গ্রেফতারকৃত বিজয়ের বাসায় নিয়ে যায়। একই দিন সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বিজয় জেসিকার ভাইকে মোবাইলফোনের মাধ্যমে জেসিকার অসুস্থতার কথা বলে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আসার জন্য বলে। পরবর্তীতে জেসির পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে জেসিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানান, গ্রেফতারকৃত বিজয় রহমান ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রেসিডেন্টসিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করে। এরপর ২০২২ সালে মুন্সীগঞ্জ সরকারী হরগঙ্গা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সে জেসি হত্যার পর থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান এলাকায় তার বন্ধুর বাড়িতে ৪ দিন, ফরিদপুরের আটরশি মাজারে ২২ দিন আত্মগোপনে ছিল। এরপর গত গত ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এসে গাঁ-ঢাকা দিয়ে থাকতে শুরু করে।
গত শনিবার রাত ৮ টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় র্যাব সদস্যরা গোপনে অভিযান চালিয়ে স্কুলছাত্রী জেসিকা মাহমুদ জেসি হত্যা মামলার প্রধান আসামী প্রেমিক বিজয় রহমানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
এদিকে, আজ দুপুরে র্যাব-৩ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) ফারজানা হক বিষয়টি বাসসকে নিশ্চিত করে জানান, গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানান তিনি।