একসময় উপজেলা জুড়ে দেখা যেত ধানখেত, এখন সেখানে চোখে পড়ে পানের বরজ। যাঁরা একসময় শ্রমিকের কাজ করতেন, তাঁরাও বাড়ির সামনে পরিত্যক্ত জায়গায় পানের চাষ করছেন। পান চাষ করে এলাকার অনেকেই ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। পানের বরজে ঘেরা এই উপজেলার নাম কাপাসিয়া। কাঁঠালের রাজধানীখ্যাত গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় অধিক লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে পান চাষীর সংখ্যা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাপাসিয়ার বারিষাব, রায়েদ, কুশদী, চরদুর্লভ খাঁসহ উপজেলার অন্তত ২ থেকে ৩ হাজার পরিবারের মূল নির্ভরতা পান চাষে। প্রতি সপ্তাহে হাটে ১ একর জমির পানের বরজ থেকে আয় হয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। উৎপাদন খরচ কম ও বহুবর্ষজীবী হওয়ায় পান চাষে আগ্রহ বাড়ছে এখানকার কৃষকদের। এক সময় শুধু উপজেলার কিছু এলাকায় পান চাষ হলেও এখন ছড়িয়েছে ঘরে ঘরে। পানের বরজে ভাগ্যের চাকা ঘুরে হাসি ফুটেছে অনেক কৃষকের মুখে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের।
চরদুলভ খাঁ এলাকার কৃষক আহছানউল্লাহ মোড়ল বলেন, একবার বরজ তুলতে পারলে ১০-১৫ বছর থাকে। কোনো বালা-মুসিবত না হলে পানের বরজে তেমন কোনো খরচ হয় না। আমাদের এলাকার উৎপাদিত পান যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। পাইকারি দরে পান কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করেন পাইকাররা। স্থানীয় বাজারে বেচাকেনা হয় লক্ষ লক্ষ টাকার পান। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উচিত আমাদের মতো পান চাষীদের উপর বিশেষ নজর দেয়ার।
এদিকে কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, প্রতি বিঘা জমির পানের বরজে মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি, শ্রমিক, পানের লতাসহ ১ থেকে দেড় লাখ টাকা প্রাথমিক অবস্থায় খরচ হয়। পরের বছর থেকে খরচ খুবই সামান্য হয়। কারণ একটি পানের বরজ তৈরি করার পর মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি সংস্কার ছাড়া ৪০-৪৫ বছর পর্যন্ত পানের বরজ অক্ষুণ্ণ থাকে। সেখান থেকে পান পাওয়া যায়। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পানের ভরা মৌসুম। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন কম হয়। ফাল্গুন মাসে বাড়ন্ত লতিকে নিচে নামিয়ে দেওয়াতে পানের উৎপাদন হয় না বললেই চলে। তাদের দাবি, প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কাপাসিয়ার উৎপাদিত পান রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব। পান ছোট-বড় সব বয়সের মানুষের কাছেই প্রিয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াতিদের খাবারের পর একটু পান-সুপারি না দিলে, মনে হয় কী যেন একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে।
পান চাষী আমানউল্লাহ মোড়ল জানান, পানের বরজে এক প্রকার ফাপ পঁচা রোগ দেখা দেয়। এ থেকে বাঁচাতে পারলে একটি বরজ ২০ থেকে ২৫ বছর থাকে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবন মাসে এ রোগটি বেশি দেখা যায়। এটি পানের সবচেয়ে বড় রোগ। তবে এ রোগ দমনে ফোরি, এডমা ও কাফডার নামে তিনটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও শীত মৌসুমে এক প্রকার বিষাক্ত কুয়াশা পান গাছে লাগলে পান পাতা ঝরে পড়ে যায়। এতে চাষিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা প্রতিরোধে কোন ওষুধ না থাকায় মাঝে মধ্যে বিপাকে পড়তে হয় চাষিদের। অনেক চাষি কুয়াশা ঠেকানোর জন্য বরজের চারপাশ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়।
পান চাষে ফলন ভালো পাওয়ার ক্ষেত্রে উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিয়াসমিন আক্তারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, জৈব সারের পাশাপাশি জমিতে সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে পান চাষে ফলন ভালো হয়। প্রতি শতক জমিতে খৈল (২০ কেজি), এসএসপি (২.৫ কেজি), এমওপি (৬০০ গ্রাম), ইউরিয়া (১.৮ কেজি) সার সমান চার ভাগ করে বছরে ৪ বার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এরমধ্যে দু’বার বর্ষাকালে, শরৎ ও বসন্তকালে একবার করে দিতে হবে। কোনোভাবেই জমিতে বেশি পানি রাখা যাবে না। রোদে মিশ্রণ দিয়ে মাটি শোধন করলে রোগের আক্রমণ তুলনামূলক কম হয়। এরপরও আক্রমণ মোকাবেলা করতে ডায়থেন এম-৪৫ বা রিডোমিল এম জেড-৭২ ছত্রাকনাশক স্প্রে দিতে হবে। আর পান পাতায় ছিটা দাগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে কুপ্রাভিট জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে। একই সঙ্গে ছিটা দাগ পড়া পান পাতা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পান পাতা পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে বরজ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শও দেন এই কৃষি কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, এ উপজেলায় কয়েক প্রকার পান চাষ হয়। তার মধ্যে গয়ালসুর, লালডিঙ্গি, মিষ্টি পান ও ছাঁচি পান উল্লেখযোগ্য।
কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি অফিসের অতিরিক্ত কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সৈয়দ শাকিল আহমেদ বলেন, পান অর্থকরী ফসল। কাপাসিয়ায় উৎপাদিত পান বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। চাহিদাও বেশ ভালো। আমাদের কর্মীরা পান চাষিদের বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যে কোনো সমস্যায় চাষিরা যোগাযোগ করলে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।