ঢাকা ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বঙ্গবন্ধুর পছন্দেই নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনন্য এক সৃষ্টির নাম ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। চিকিৎসকদের সংগঠিত করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তার বড় ভূমিকা ছিল। 

বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭২ সালে তিনি গড়ে তুলেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামক স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য কেন্দ্র। যার নামকরণ হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুরুতে এর নাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ দেওয়া হলেও ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন এ হাসপাতালের উদ্যোগ নেওয়ার সময় নাম নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। সেই সময় বিষয়টি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন

‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না’, জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ।

‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্যে’, বললেন বঙ্গবন্ধু।

অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দুজন বসে যে নামটি ভালো সেই নামে হাসপাতাল হবে।’

তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস?’ বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, ‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র…’

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’

জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব ও ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্যে। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে সারাদেশে গণস্বাস্থ্যের ৪০টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। এগুলো সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রশংসিতও হয়েছে। এর অধীনে রয়েছে ৭টি হাসপাতাল, ডেন্টাল কলেজ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মাসিক গণস্বাস্থ্য ম্যাগাজিন, বেসিক কেমিক্যাল কারখানা (দেশের সবচেয়ে বড় প্যারাসিটামল কাঁচামাল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান) গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, অ্যান্টিবায়োটিকের কাঁচামালের ফ্যাক্টরি। এছাড়াও সারাদেশে ৪৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেয়েদের ড্রাইভিং স্কুল, ভেটেরিনারি ফার্ম, রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫টা মেডিকেল ক্যাম্প, এগ্রিকালচারাল ফার্ম, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ফার্ম রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশের কল্যাণে কাজ করতে থাকে। সারাদেশে স্বল্প মূল্যে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সর্বাধিক যে বিষয়ে অবদান রাখছে তা হলো কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস সেন্টার। ধানমন্ডিতে স্থাপিত এই সেন্টারে ৩০০টি বেড রয়েছে। আর ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে ১৩৫টি।

১৯৭৭ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বিত সমাজ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ১৯৮৫ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে রাইট লাইভহুড পুরস্কার ও ২০০২ সালে বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো পুরস্কার লাভ করে।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বোরহানউদ্দিনে খাল পরিস্কার – পরিচ্ছন্নতার অভিযানের উদ্বোধন

বঙ্গবন্ধুর পছন্দেই নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের

আপডেট সময় ১২:০৩:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ এপ্রিল ২০২৩

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনন্য এক সৃষ্টির নাম ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। চিকিৎসকদের সংগঠিত করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তার বড় ভূমিকা ছিল। 

বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭২ সালে তিনি গড়ে তুলেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামক স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য কেন্দ্র। যার নামকরণ হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুরুতে এর নাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ দেওয়া হলেও ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন এ হাসপাতালের উদ্যোগ নেওয়ার সময় নাম নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। সেই সময় বিষয়টি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন

‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না’, জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ।

‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্যে’, বললেন বঙ্গবন্ধু।

অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দুজন বসে যে নামটি ভালো সেই নামে হাসপাতাল হবে।’

তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস?’ বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, ‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র…’

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’

জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব ও ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্যে। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে সারাদেশে গণস্বাস্থ্যের ৪০টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। এগুলো সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রশংসিতও হয়েছে। এর অধীনে রয়েছে ৭টি হাসপাতাল, ডেন্টাল কলেজ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মাসিক গণস্বাস্থ্য ম্যাগাজিন, বেসিক কেমিক্যাল কারখানা (দেশের সবচেয়ে বড় প্যারাসিটামল কাঁচামাল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান) গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, অ্যান্টিবায়োটিকের কাঁচামালের ফ্যাক্টরি। এছাড়াও সারাদেশে ৪৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেয়েদের ড্রাইভিং স্কুল, ভেটেরিনারি ফার্ম, রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫টা মেডিকেল ক্যাম্প, এগ্রিকালচারাল ফার্ম, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ফার্ম রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশের কল্যাণে কাজ করতে থাকে। সারাদেশে স্বল্প মূল্যে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সর্বাধিক যে বিষয়ে অবদান রাখছে তা হলো কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস সেন্টার। ধানমন্ডিতে স্থাপিত এই সেন্টারে ৩০০টি বেড রয়েছে। আর ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে ১৩৫টি।

১৯৭৭ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বিত সমাজ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ১৯৮৫ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে রাইট লাইভহুড পুরস্কার ও ২০০২ সালে বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো পুরস্কার লাভ করে।