৫৭০ তিব্বত সাবান, এটি মূলত একটি কাপড় কাচার সাবান। তবে এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক অনেক ঘটনা! আর এমনই একটি স্মৃতিমাখা ঘটনা জড়িয়ে আছে এই সাবান এর সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দাফনকারী তৎকালীন পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল) নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাজী সিরাজুল ইসলাম (৭৪) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত পেতে চান। এই সাহসী মানুষটি সেদিন বঙ্গবন্ধুর মরদেহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সামনে বলেছিলেন ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক মুসলিম রীতিতে বঙ্গবন্ধুকে গোসলসহ দাফন-কাফন করতে হবে।
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং
ইতনা গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোসহ দাফন-কাফনের সেদিনের মর্মস্পর্শী ঘটনা। এ সময় সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আলী আজগর রাজা, শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, কাজী সিরাজুল ইসলামের বাল্যবন্ধু কাজী বাবুল হোসেন, বড় ছেলে শরিফুল ইসলাম, শিকদার ফারুক হোসেন, কাজী শরাফত হোসেনসহ গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
কনস্টেবল কাজী সিরাজুল ইসলাম (কনস্টেবল নম্বর-২০৭৩) জানান, ১৯৭৫ সালের আগস্টে গোপালগঞ্জ তৎকালীন সাব-ডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) আব্দুল মান্নানের দেহরক্ষী (বডিগার্ড) ছিলেন তিনি। ১৪ আগস্ট পুলিশের নতুন পোশাক আনতে ফরিদপুর যান। ওই সময় বেতন, রেশন, কাপড় সবই ফরিদপুর থেকে দেয়া হতো। ওই রাতে খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাছে থাকা রেডিও বন্ধ করতে মনে ছিল না। রাত পৌনে ৩টার দিকে রেডিওর খবরে শুনি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খবর শুনে ওই সময় পুলিশের পোশাক পরে গোপালগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম। অনেক কষ্ট করে ভোরে গোপালগঞ্জের বাসায় এসে পৌঁছালাম। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এক পুলিশ বাসায় এসে জানালেন, এসডিপিও স্যার দ্রুত ডেকে পাঠিয়েছেন। পোশাক পরে দ্রুত স্যারের কাছে চলে গেলাম। পরে তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের স্যার, এসডিপিও আব্দুল মান্নান স্যার এবং আমি একটি স্পিডবোডে করে টুঙ্গিপাড়া যাই। সেখানে গিয়ে থানায় অবস্থান করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তখনও আসেনি। এরই মধ্যে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খোড়ার কাজ চলছে। বেলা আনুমানিক ১০টা-১১টার দিকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হেলিকপ্টার করে নিয়ে আসা হলো। মরদেহের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একজন মেজর ও সিপাহী দেখতে পেলাম।
হাসপাতাল ও পুলিশের লোক মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে এলো। কাঠ দিয়ে তৈরি কফিন খোলার পর দেখা গেল মরদেহ চা পাতি আর বরফ দিয়ে ঢাকা। মরদেহ সাদা একটি কাপড় দিয়ে মোড়ানো। কাপড়টি কাফনের কাপড় নয়, এমনি একটি কাপড়। তখন ওই মেজরের কাছে বললাম, স্যার মনে হচ্ছে লাশের তো গোসল হয়নি। মেজর সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, কে কার গোসল করাবে। আমি বললাম, মুসলমান হিসেবে তাকে গোসল করাতে হবে, কাফন দিতে হবে। তারপর দাফন করতে হবে। তখন তিনি রেগে গিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি কোথায়। তিনি ভেবেছিলেন আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় হবো। আমি বললাম নড়াইলের লোহাগড়া থানার ইতনা গ্রামে আমার বাড়ি। মেজর বললেন, দেরি করলে লাশ ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। আমি বললাম, স্যার ১৪৪ ধারা জারি আছে। ফোর্স দিয়ে টুঙ্গিপাড়া ঘেরাও আছে। তিনি বললেন, গোসল কে করাবে, কত সময় লাগবে। আমি বললাম, গোসল আমি করাবো এবং আধাঘণ্টার মধ্যে হয়ে যাবে। তখন গোসল করানোর অনুমতি দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল গাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। গোসল করানোর সময় বঙ্গবন্ধুর চাচাতো চাচা আব্দুল মান্নান টিনের দুটি পুরানো বালতি আর সিলভারের একটি বদনা নিয়ে আসলেন। গোসল করানোর জন্য আনা হলো ৫৭০ কাপড় কাচার সাবান। তখন এতো খারাপ লাগলো এই ভেবে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করাতে হলো ৫৭০ কাপড়কাচা সাবান দিয়ে। একথা চিন্তা করতে দুচোখ দিয়ে পানি এলো। জাতির জনককে গোসল করালাম নিজ হাতে। বঙ্গবন্ধুকে গোসল করাতে গিয়ে দেখলাম বুকের বামপাশে তিনটি গুলির চিহ্ন। আরেকটা গুলি ডান হাতের আঙুলে লেগেছিল। গুলি লেগে আঙুলটি উল্টে গেছে।
গোসলের পর কাফনের কাপড়ের দরকার। তখন ইতনা গ্রামের বাসিন্দা মোকলেছুর ছিলেন টুঙ্গিপাড়া থানার সেকেন্ড অফিসার। উনি বললেন, আমি কাফনের কাপড় নিয়ে আসছি। কাফনের জন্য যে কাপড় পাওয়া গেল সেটি মার্কিন থান কাপড়। এটি রিলিফের কাপড়। কাপড় জোড়া দিয়ে কাফনের কাপড় প্রস্তুত করা হলো। কাফন দেয়ার সময়ও বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। কয়েকবার রক্ত পরিষ্কার করার পর কাফন করলাম। এরপর জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। জানাজায় ২০-২৫ জন লোক ছিলাম। পুলিশ স্টাফ আর হাসপাতালের লোক জানাজায় অংশ নিলেন। জনসাধারণকে জানাজায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। জানাজা শেষে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনের জন্য কবরের কাছে নিয়ে এলাম। জাতির জনকের মরদেহ আমি নিজ হাতে কবরে রেখেছি। কবরে বাঁশের স্তর দিয়ে ঢেকে দেবো। এমন সময় কয়েকজন মহিলা ওই মেজরের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করছে এই বলে, তাদের যেন একবার বঙ্গবন্ধুর মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে দেওয়া হয়।
মেজর বললেন, না এখন দেখানো যাবে না। তখন আমি তাদেরকে বললাম আপনাদের বাড়ি কোথায়। তারা জানালো, তাদের বাড়ি কোটালিপাড়া। তখন আমি বললাম স্যার ১০-১২ মাইল রাস্তা পার করে এরা কষ্ট করে এসেছে চোখের দেখা দেখতে। তখন মেজর বললেন, কে দেখাবে। তখন আমি বললাম, স্যার আমি দেখাবো। মেজর আমার উপর ক্ষেপে গিয়ে বললেন আপনিতো আচ্ছা লোক। লাশ আসার পর থেকে এর পিছনে লেগেই আছেন। তখন আমি আবার কবরে নেমে তাদেরকে লাশের মুখ দেখালাম। উনারা বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখেই হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। আমি তাদেরকে বললাম আপনারা উনার জন্য দোয়া করেন। পরে দোয়া পড়ে কবর থেকে উঠে এলাম।