ঢাকা ০৬:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ আখ্যায়িত করার দাবি বাকেরগঞ্জের বিরঙ্গল দারুসুন্নাত নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসাটির বিভিন্ন অনিয়ম রয়েছে গোপালগঞ্জের সোহাগ একসঙ্গে দুই সরকারি চাকরি করেন বেরোবিতে স্বৈরাচারী দোসর ও শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ষড়যন্ত্রকারী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদে মানববন্ধন বিটিভির সংবাদ বেসরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচারের প্রয়োজন নেই : নাহিদ শুক্রবারও চলবে মেট্রোরেল চাঁপাইনবাবগঞ্জ র‍্যাব ক্যাম্পের অভিযানে দু’কোটি টাকার হেরোইন উদ্ধার, আটক-১ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলেই ভাসতে থাকে প্রথম শ্রেণীর জাজিরা পৌরসভা। চট্টগ্রামে সাবেক সাংসদ বাদলের কবরে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ

১৬ বছরে ১০ বার ফাঁস মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র: সিআইডি

ঢাকা: ২০০১ সাল থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে তথা ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বার ফাঁস হয়েছে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। এ ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। এই চক্রটি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।  

 

রোববার (১৩ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১২টায় রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।

তিনি বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ১১ দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার ১০০ থাই বাথ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড জব্দ করা হয়।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে এলেই চক্রটি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই চক্র নানান কায়দায় প্রশ্নফাঁস করে, পাশাপাশি গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে। শিক্ষাখাতের ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রকে নির্মূল করতে কাজ করছে পুলিশ।

তিনি বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ। ২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলায় সম্প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য বিগত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরমধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথাও জানান তিনি।

সিআইডিপ্রধান বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভুঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ২০২০ সালের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূলহোতা জসীম উদ্দীন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান জসিমের খালাতো ভাই মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আদালতে দেওয়া চৌষট্টি ধারার জবানবন্দিতে এই ১২ জনের নাম আসে। দীর্ঘ দিন তারা পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।

অতিরিক্ত আইজিপি  বলেন, গ্রেপ্তার মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম দুই সদস্য স্বামী -স্ত্রী। তারা দুজনেই চিকিৎসক। স্বামী চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামে কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত-শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি প্রশ্নফাঁস ও মানিলন্ডারিং দুই মামলাতেই এজাহারনামীয় আসামি। ময়েজ চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা এবং পরবর্তীতে জামায়াতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী গ্রেপ্তার সোহেলী জামান (৪০) প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চক্ষু ডাক্তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামে কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ময়েজের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি।

সিআইডিপ্রধান জানান, আরেক গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো. আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেন।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আরেক হোতা জানিয়ে সিআইডিপ্রধান বলেন,  শোভন প্রশ্নফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে থ্রি-ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন ডা. শোভন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো.জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত।

সিআইডির দাবি, জোবাইদুর রহমান নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি হোতা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন জনি। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন।

২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‍্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিল। বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক তিনি।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২) তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে ডাক্তারি পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুর-টাকুর পাড়ায় নিজ শ্বশুরবাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করান।

সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার জহিরুল ইসলাম ভুঁইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন।

গ্রেপ্তার রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরোনো সহযোগী। রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত তিনি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

সিআইডিপ্রধান আরও বলেন, গ্রেপ্তার আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। মেডিকেল প্রশ্নফাঁস মামলার এজহারনামীয় আসামি। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে র‌্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের পুরানো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সাল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।

গ্রেপ্তার আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নফাঁসের এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল আসতেন।

Tag :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ আখ্যায়িত করার দাবি

১৬ বছরে ১০ বার ফাঁস মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র: সিআইডি

আপডেট সময় ০৬:১৮:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৩

ঢাকা: ২০০১ সাল থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে তথা ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বার ফাঁস হয়েছে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। এ ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। এই চক্রটি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।  

 

রোববার (১৩ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১২টায় রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।

তিনি বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ১১ দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার ১০০ থাই বাথ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড জব্দ করা হয়।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে এলেই চক্রটি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই চক্র নানান কায়দায় প্রশ্নফাঁস করে, পাশাপাশি গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে। শিক্ষাখাতের ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রকে নির্মূল করতে কাজ করছে পুলিশ।

তিনি বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ। ২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলায় সম্প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য বিগত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরমধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথাও জানান তিনি।

সিআইডিপ্রধান বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভুঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ২০২০ সালের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূলহোতা জসীম উদ্দীন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান জসিমের খালাতো ভাই মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আদালতে দেওয়া চৌষট্টি ধারার জবানবন্দিতে এই ১২ জনের নাম আসে। দীর্ঘ দিন তারা পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।

অতিরিক্ত আইজিপি  বলেন, গ্রেপ্তার মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম দুই সদস্য স্বামী -স্ত্রী। তারা দুজনেই চিকিৎসক। স্বামী চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামে কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত-শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি প্রশ্নফাঁস ও মানিলন্ডারিং দুই মামলাতেই এজাহারনামীয় আসামি। ময়েজ চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা এবং পরবর্তীতে জামায়াতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী গ্রেপ্তার সোহেলী জামান (৪০) প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চক্ষু ডাক্তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামে কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ময়েজের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি।

সিআইডিপ্রধান জানান, আরেক গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো. আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেন।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আরেক হোতা জানিয়ে সিআইডিপ্রধান বলেন,  শোভন প্রশ্নফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে থ্রি-ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন ডা. শোভন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো.জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত।

সিআইডির দাবি, জোবাইদুর রহমান নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি হোতা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন জনি। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন।

২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‍্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিল। বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক তিনি।

গ্রেপ্তার চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২) তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে ডাক্তারি পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুর-টাকুর পাড়ায় নিজ শ্বশুরবাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করান।

সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার জহিরুল ইসলাম ভুঁইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন।

গ্রেপ্তার রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরোনো সহযোগী। রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত তিনি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

সিআইডিপ্রধান আরও বলেন, গ্রেপ্তার আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। মেডিকেল প্রশ্নফাঁস মামলার এজহারনামীয় আসামি। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে র‌্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের পুরানো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সাল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।

গ্রেপ্তার আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নফাঁসের এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল আসতেন।