ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এর আগে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো চলবে; তবে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলাগুলোর বিচার হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সোমবার (৭ আগস্ট) সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
এর আগে, সকালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা কক্ষে এ বৈঠক হয়।
আইনটিকে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ (আইনপ্রণয়ন) বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক মন্ত্রিসভায় নতুন আইনটি উত্থাপন করেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবর্তন করা হয়েছে। যদি এখন বলি— বাতিল করা হয়েছে, তাহলে আপনারা প্রশ্ন করবেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব ধারাই তো এ আইনে আছে। তাহলে আপনি কেন বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। যে কারণে আমি পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করেছি।
তিনি বলেন, ডিজিটাল প্রগ্রেস (অগ্রগতি) সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আইনটির নাম দেওয়া হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সাইবার নিরাপত্তার জন্য যে ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলো এখানে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। সেগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয়ত, যেটি করা হয়েছে— ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটি ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। সেই কারাদণ্ডের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানহানির একমাত্র সাজা জরিমানা। এখন জরিমানা যদি না দেওয়া হয়, তাহলে কারাদণ্ড থাকবে। সেটাও জরিমানার ওপর ভিত্তি করে তিন মাস বা ছয়মাসের কারাদণ্ড থাকবে। কিন্তু মূল শাস্তি হলো জরিমানা। এখানে অনেকগুলো ধারা যেগুলো আগে অজামিনযোগ্য ছিল, সেগুলোকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, তৃতীয়ত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১-এ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত— এসব নিয়ে যদি কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে, তাহলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এর সাজা ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড, এটি কমিয়ে এখন সাত বছর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকগুলো ধারার মধ্যে ছিল, দ্বিতীয়বার যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে সেই সাজা দ্বিগুণ হয়ে যেত কিংবা সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। প্রতিটি আইনে যেখানে দ্বিতীয়বার সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। নতুন আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধ করলেও প্রথমবার অপরাধ করলেও যে সাজা থাকবে, দ্বিতীয়বারের জন্যও একই সাজা থাকবে।
মন্ত্রী বলেন, যেগুলো টেকনিক্যাল অপরাধ, যেগুলো সাইবার সিকিউরিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার, সবসময়ই জনগণের কথা শোনার সরকার ছিল, যেটিকে ইংরেজিতে আমরা বলি, উই আর অ্যা লিসেনিং গভর্নমেন্ট। এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অপব্যবহার কিংবা মিসইউজ রোধ করতে আমরা নাম পরিবর্তন করেছি। যেমন, আগে মানহানিতে কারাদণ্ড ছিল, সেখানে এখন কারাদণ্ড নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে একটা মানসিক চাপ থেকে যায়। স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনে একটি মানসিক চাপ থাকে। সেটিকেও আমরা কর্তব্যের মধ্যে নিয়েছি। এ কারণে আমরা পরিবর্তন করেছি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি সংশোধন নাকি নতুন আইন হিসেবে আসছে, প্রশ্নে তিনি বলেন, নতুন আইন হিসেবে আসছে।
তার মানে তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর থাকছে না, বাতিল হয়ে গেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আবারও বলছি, সঠিকভাবে বলার জন্য, পরে আর ব্যাখ্যা দিতে চাই না—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। নিশ্চয়ই নামটি নতুন করে দেওয়া হয়েছে। যেসব ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে, বিষয়টি হচ্ছে, এটি যেভাবে করা হয়েছে, সেভাবে করা যেতো। আরেকটি বিষয় হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সংশোধন করা যেতো। আমরা যখন দেখেছি, একই আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সেখানে আমরা মনে করেছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে তার জায়গায় সাইবার নিরাপত্তা আইন আনলে পরে জনগণসহ সবার জন্য এটি কনফিউজিং (বিভ্রান্তিকর) হবে না।
তিনি আরও বলেন, আইনে ও নামে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অনেক জায়গায় সাজার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, তা কমানো হয়েছে। যেখানে উপধারা দিয়ে কিংবা দ্বিতীয়বার, পুনঃপুনবার করলে সাজা দ্বিগুণ হয়ে যেত, সেসব ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা না, সাইবার নিরাপত্তা আইন নামেই এটি পরিবর্তন হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রহিতকরণ ও হেফাজতকরণের প্রভিশন রেখে আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন করেছি।
সাইবার অপরাধ রোধ করার জন্য এগুলো করা হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, যেগুলো টেকনিক্যাল অফেন্স, সেগুলো কিন্তু আমরা জামিনযোগ্যও করিনি, সাজাও কমানো হয়নি, ৩০ ধারা থাকবে। ৩১ ধারায় আগে ছিল সাত বছর, এখন কমিয়ে আনা হয়েছে পাঁচ বছরে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে আগে ছিল ১৪ বছর এখন সাত বছর করা হয়েছে। এখানেও পুনঃসংগঠন করলে যে শাস্তি, তা বাতিল করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ বলে একটি অপরাধ এখানে নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড করা হয়েছে। ৩৩ ধারায় বেআইনি তথ্য, উপাত্ত ধারণ, হস্তান্তর, স্থানান্তর ইত্যাদি, এটিকে হ্যাকিং নামে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমার মনে হয়, ৩৩ ধারাটিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং এর অপরাধ করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি হ্যাক করেন, তাহলে সেটি হবে একটি অপরাধ। সেজন্য তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তিনি বলেন, হ্যাকিং মানে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের তথ্যভাণ্ডার থেকে কোনো তথ্য বিনাশ বাতিল, পরিবর্তন, এর মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাসকরণ, অন্য কোনোভাবে ক্ষতি সাধন, নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে এর ক্ষতি সাধন।
এখানে গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোন প্রভিশন রাখা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোনো প্রভিশন রাখা হয়নি।
পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের যে ধারাটি ছিল, সেটি পরিবর্তন করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিজিটাল অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক সময় যে যন্ত্র দিয়ে সেটি করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে সেটি জব্দ না করা হয়, তাহলে সাক্ষ্যপ্রমাণ হারিয়ে যাওয়ার একটি শঙ্কা থাকে। সে কারণে আমার মনে হয়, ৪৩ নম্বর ধারাটি থাকার প্রয়োজন। এ আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ নম্বর ধারায় যে প্রভিশন ছিল, সেটি আছে।
তাহলে ৪৩ ধারা অনুযায়ী মামলা হলেই যে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করে, সে বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে কি না— জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, সব চেয়ে বড় কথা হলো, এখন কোনো কারাদণ্ড নেই। তাহলে কেন গ্রেপ্তার করা হবে? গ্রেপ্তারের কোনো সম্ভাবনাই থাকল না। এখন আর গ্রেপ্তার হবে না।
তাহলে কি মানহানির মামলার ক্ষেত্রে আর গ্রেপ্তার করা যাবে না বিষয়টা কি এমন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, না অবশ্যই এটা তো আর কারাদণ্ড না।
কয়টি ধারায় পরিবর্তন হয়েছে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, অনেকগুলো ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। মামলাগুলো চলবে। তবে মামলার যে কার্যক্রম, তা সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আইনটি উঠবে, সেখানে এ আইনটি পাস করা হবে।