দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা চাপি দেওয়া হচ্ছে, ধনীদের ওপর থেকে দিন দিন করের চাপ কমানো হয়েছে। এই দেশের যে যত বড় ব্যবসায়ী, তত বড় দুর্নীতিবাজ। বিভিন্নভাবে ফাঁক-ফোকর দিয়ে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে আয় বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সোমবার (২১ নভেম্বর) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে ওয়েভ ফাউন্ডেশন ও ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় আয়োজিত এক বছর মেয়াদি প্রোমোটিং সিটিজেনস্ পার্টিসিপেশন ফর প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন প্রকল্পের ‘স্টার্ট-আপ ইভেন্ট’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তারা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান কর ব্যবস্থায় বেশির ভাগই পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল, যা দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায্য নয়। ভ্যাট দরিদ্রদের প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল। পরোক্ষ এ কর ব্যবস্থা সমাজের সচ্ছল অংশের তুলনায় দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ কেড়ে নেয়।
অন্যদিকে ভ্যাটের কার্যকারিতা সবার ক্ষেত্রে সমান প্রভাব ফেলে বলে এটি দরিদ্রের ওপর একটি বোঝা তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত দরিদ্র এবং ধনীর মধ্যে আয়-বৈষম্য সৃষ্টি করে। দরিদ্র মানুষকে ধনীদের তুলনায় প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোতে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। তাই প্রয়োজন জনঅংশগ্রহণমূলক একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা।
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উপ-সচিব মো. তাজুল ইসলাম।
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমার সঞ্চালনায় এতে প্রকল্প পরিচিতি তুলে ধরেন প্রকল্পের সমন্বয়ক নির্মল দাস এবং আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের ফ্যাসিলিটের অনিরুদ্ধ রায়। ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর ন্যায্যতা’ বিষয়ক গবেষণার সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন গবেষণা সহযোগী ও ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি’র প্রভাষক সানজিদা ইসলাম। এছাড়া অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে নাগরিক সমাজের সংগঠন ও যুব সমাজের প্রতিনিধিরা এতে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
ধনী ব্যক্তিরা কর ফাঁকি দেন, দুর্নীতি করেন উল্লেখ করে স্টার্টআপ ইভেন্টের সভাপতি মহসিন আলী বলেন, যত বড় ব্যবসায়ী তত বড় দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও দরিদ্র ও ধনীর মধ্যে বৈষম্য কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। যত কম কর দিতে হোক, গরিব মানুষের কাছে সেই অর্থ কিন্তু অনেক। গরিব মানুষকে তো শুধু খাদ্য নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসও জীবনধারণের জন্য কিনতে হয়। ফলে সেটা অবশ্যই তার জন্য চাপের। ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে না পারলে সরকার এমডিজি বাস্তবায়নে যে সাফল্য পেয়েছে, এসডিজি বাস্তবায়নে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের পক্ষ থেকে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করতে হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র মানুষকে পরোক্ষভাবে ভ্যাট দিতে হলেও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। চাল ও কাঁচা সবজির ওপরে ভ্যাট নেই। সরকার সবার মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে বছর বছর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করছে। সব কর্মসূচি ক্রমশ ডিজিটালাইজেশনের অধীনে চলে এলে যথাযথভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমস্যা আরও কমে আসবে। বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রেও ডিজিটাইজেশন এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে এর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে।
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনকালে সানজিদা ইসলাম বলেন, বর্তমানে পরোক্ষ করের পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ। ভ্যাট ধনী-গরিবের মধ্যে সমানভাবে প্রয়োগ হয় বলে তা একটি অন্যায্য প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ কোথাও নেই বললেই চলে। আয়কর প্রদান প্রক্রিয়া এত জটিল যে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি বা দ্বিধা রয়েছে। তিনি এ প্রক্রিয়াগুলোকে সহজতর করা, জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও পরোক্ষ করের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
প্রকল্প কার্যক্রম উপস্থাপনকালে নির্মল দাস বলেন, নাগরিক সমাজের সংগঠন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং যুবদের সম্পৃক্ত করে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা এবং নাগরিক ও নীতিনির্ধারক উভয়ের অংশগ্রহণের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য অংশগ্রহণমূলক পরিসর তৈরি করা এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। সেজন্য যুবসমাজ, নাগরিক সমাজের সংগঠন ও প্রতিনিধিদের জন্য প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আয়োজন, গবেষণা পরিচালনা, গণমাধ্যমকর্মী ও জোটের সঙ্গে আলোচনা, গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার, যোগাযোগ উপকরণ প্রস্তুত, আয়কর দিবস উদযাপন এবং জাতীয় পর্যায়ে নীতি-সংলাপ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।